অস্ত্র ছাড়াই থানা কম্পাউন্ডে ঢুকি

আমরা পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে আমি মেঝো। যুদ্ধকালীন সময়ে তখন আমি চৌমুহনী কলেজের ছাত্র। যুদ্ধের আগেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে সেদিন যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সশস্ত্র যুদ্ধ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করাসহ নানান কাজেই সময় চলে যায়। এপ্রিলের মধ্যভাগে ট্রেণিংয়ের জন্য ভারতের চোত্তাখোলা হয়ে হাপলং ট্রেণিং সেন্টারে পৌঁছি। প্রায় দুই মাস ট্রেণিং শেষে মধ্য জুনে ফিরে আসি। নিযুক্ত হই তখন কোম্পানীগঞ্জ থানা বিএলএফ’র ডেপুটি কমান্ডার হিসাবে। তখন কোম্পানীগঞ্জ থানা বিএলএফ কমান্ডার ছিলো আব্দুর রাজ্জাক। ওবায়দুল কাদের এলাকায় আসার পর তিনি থানা বিএলএফ এর কমান্ডার নিযুক্ত হন।
ছয় ডিসেম্বর একাত্তর। সিরাজপুর চৌধুরী বাড়িতে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য থানা বিএলএফ কমান্ডার ওবায়দুল কাদের, প্রাক্তন কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক আর আমি একত্রিত হই। আমাদের সাথে যোগ দেন আওয়ামীলীগ নেতা কালা মিয়া সওদাগর। সেখানে বসেই আমরা রেডিও’র খবরে শুনতে পাই বাংলাদেশকে ভারত সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। খাবার খেতে খেতেই সিদ্ধান্ত নিই রাতেই কোম্পানীগঞ্জ থানা আক্রমনের। আর এই দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। তখন কোম্পানীগঞ্জ থানার দুটি বিল্ডিংয়ের মধ্যে একটিতে থাকতো পাকিস্তান সরকারের অুনগত পুলিশ অন্যটিতে আনসার ও রাজাকার মিলিশিয়ারা।
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতেও থানায় নিয়মিত যাতায়ত ছিলো বসুরহাট (কোম্পানীগঞ্জ থানা সদর) বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হাসেমের। সন্ধ্যায় আবুল হাসেমের মাধ্যমে পুলিশ ও রাজাকার মিলিশিয়াদের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠাই আমি। ততক্ষণে সবত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভারতীয় মিত্র বাহিনীও কোম্পানীগঞ্জ থানা আক্রমন করতে আসছে। আবুল হাসেমের মাধ্যমেই সন্ধ্যার পর থেকে আলোচনা চলে পুলিশ ও রাজাকার মিলিশিয়াদের আত্মসমর্পণ নিয়ে। কিন্তু কিছুতেই তাঁরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হচ্ছিলো না।
রাত তখন প্রায় দেড়টা, অস্ত্র ছাড়াই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়াল টপকে থানা কম্পাউন্ডে ঢুকি। ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে আগ থেকেই চিনতেন থানার ওসি আবু তাহের মোল্লা ও আনসার (রাজাকার মিলিশিয়া) কমান্ডার আকতারুজ্জামান। ওসি আবু তাহের মোল্লার বদলী নির্দেশ এসেছে, থানায়ও এসেছেন আব্দুল কুদ্দুস নামের নতুন এক ওসি। তাদের সাথে কথা শুরুর আগেই সীমান্ত (ফেনীর সীমান্ত) এলাকায় বিকট শব্দে গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটে। যার আওয়াজ কোম্পানীগঞ্জ থানায় দাঁড়িয়েও শোনা যায়। মনে হয় যেনো থানার পাশেই কোথাও গোলা বর্ষণ করা হয়েছে। আর পুলিশ ও রাজাকাররা মনে করেছিলো এটি কোম্পানীগঞ্জেই ঘটেছে। এতে তাঁরা ভড়কে যায়। এসময় তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনী যৌথ আক্রমন করলে তাদের মৃত্যু ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এরচেয়ে আত্মসমর্পণ করাই ভালো।
শেষ পর্যন্ত ওসি আবু তাহের মোল্লা ও আব্দুল কুদ্দুস এবং রাজাকার কমান্ডার আকতারুজ্জামান আত্মসমর্প করতে সম্মত হয়। এসময় তাদের সাথে তিন সিপাহীও আত্মসমর্পন করে (তখনো থানার দুটি বিল্ডিংয়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও রাজাকার অবস্থান করছিলো)। তাদের কাছ থেকে এলএমজি, ষ্টেনগান ও রাইফেল ছিলো। তাদের নিয়ে থানা থেকে আসার সময় থানার হ্যান্ড মাইকটি নিয়ে আসি। থানা থেকে বেরিয়ে এ ছয়জনকে নিয়ে যাই কোম্পানীগঞ্জ সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসের সামনে, সেখানে যে কোনো ধরণের অভিযানের জন্য পূর্ব থেকেই অপেক্ষা করছিলেন ওবায়দুল কাদেরসহ (সেতুমন্ত্রী) মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ।
সকালে এখবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ জনতা থানা অভিমুখে জড়ো হলে পুলিশ এবং রাজাকার নির্বিচারে জনতার ওপর গুলি চালাতে পারে এজন্য তখন নেতৃবৃন্দসহ সিদ্ধান্ত নিই রাতেই বাকীদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করার। তারপর থানা থেকে নিয়ে আসা হ্যান্ড মাইকটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মুসলিম কমার্সিয়াল ব্যাংকের (বর্তমান রূপালী ব্যাংক) সামনে আসা মাত্রই ব্যাংক থেকে দারোয়ান দৌড়ে বেরিয়ে এসে খবর দিয়ে বলে ‘কাগা আঙ্গো ব্যাংকের ভিতরে জনাল মিয়ার (শান্তি কমিটির সভাপতি জয়নাল আবেদীন) হোলা নাজমুল হুতি রইছে’ (কাকা আমাদের ব্যাংকের ভতরে জয়নাল মিয়ার ছেলে শুয়ে আছে)। ব্যাংকে গিয়ে জয়নালকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বাকী রাজাকার ও পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পনের প্রস্তাব দিয়ে থানায় পাঠাই। তখন রাত ৩টা। দ্বিধা দ্বন্ধের মধ্যে পড়ে যায় থানা বিল্ডিংয়ে থাকা রাজাকার মিলিশিয়া ও পুলিশ সদস্যরা।
ভোর হয়ে আসছে তখনো কোন আশাব্যঞ্জক খবর না আসায় থানার সামনের ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে হ্যান্ড মাইকে পুলিশ ও রাজাকারদেরকে আত্মসমর্পনের আহবান জানাই। মাইকে ঘোষণা দিই মুক্তিযোদ্ধারা থানা ঘিরে ফেলেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই থানা উড়িয়ে দেওয়া হবে, আক্রমন হলে সবাইকে মরতে হবে ইত্যাদি কথা বলে তাঁদের মনোবল ভেঙ্গে দিই। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে থানা থেকে একে একে পুলিশ ও আনসার (রাজাকার মিলিশিয়া) সদস্যরা বেরিয়ে আসতে থাকে। একে একে ৯০ জনের কাছ থেকে অস্ত্র গ্রহণ করি। সাত ডিসেম্বর সকালেই আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) কোম্পানীগঞ্জ থানার নিয়ন্ত্রন গ্রহণ করি।
এখনো ৭১’র ৬ ডিসেম্বরের সেই ঘটনাবহুল রাত স্মৃতিতে ঝলঝল করে আছে। বিজয়ের পাঁচ দশকেও এতটুকু ম্লান হয়নি সেই স্মৃতি। ভাগ্য খারাপ হলে নিশ্চিত মৃত্যু, এট্ াজেনেই এবং অস্ত্র ছাড়াই থানা কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেছিলাম তখন।
বেদনাদায়ক স্মৃতি হচ্ছে সহযোদ্ধাদের হারানো। ৪ সেপ্টেম্বর সকালে তখনকার থানা বিএলএফ কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের সাথে বামনী বেড়ির ওপর সুসজ্জিত পাকিস্থানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। বামনী যুদ্ধ নামে সেই যুদ্ধ দুইজন পাকিস্থানী সেনা মারা গেলেও আমাদের মারা গিয়েছিলো ছয় জন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন চৌমুহনী কলেজের মেধাবী ছাত্র সালেহ আহম্মদ মজুমদার (পরবর্তীতে তাঁরা নামানুসারে চৌমুহনী সালেহ আহম্মদ কলেজ নামকরণ করা হয়), কিশোর আমান উল্যা ফারুক, টগবগে তরুন মোস্তফা কামাল ভুলু, আব্দুর রব বাবু, আকতারুজ্জামান লাতু ও ইসমাইল। গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তখন আবু নাছের।
এছাড়া ৯ ডিসেম্বর রামপুরের তালমোহাম্মদের হাটে রাজাকার মিলিশিয়াদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হন ডাকসুর সমাজ কল্যাণ সম্পাদক আব্দুল ওদুদ। এই সহযোদ্ধাদের হারানোর ব্যাথা আজনের চিন চিন করে উঠে বুকের মধ্যে, যখন দেখি স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্ষার জন্য অনেকেই মায়া কান্না করেন।
- অনুলিখন
রুদ্র মাসুদ
সূত্র- চলমান নোয়াখালী।