মা ও বাংলা মা

দুই
বছর হয়ে গেল আম্মা
বিছানায় পড়ে আছেন। কথাও
বলতে পারেন না। নড়া চড়া
করতে পারেন না। মুখে তুলে
খাইয়ে দিতে হয়। দুই
জন নার্স পালা করে আম্মাকে
দেখে রাখেন। অথচ; এই আম্মাই
সরাক্ষন চিল্লা চিল্লি চেঁচামেচি করে ঘর মাতিয়ে
রাখতেন। সবদিকে ছিলো উনার প্রখর দৃষ্টি, সব কিছুতেই নিয়ম। বাহির থেকে এসে জুতো
কোথায় রাখা হবে তারও
একটা নিয়ম ছিল। নিয়মের ব্যাঘাত
ঘটলে শাস্তি পেতে হতো।আম্মার নিয়মের
জ্বালায় আমরা সবাই ছিলাম
অতিষ্ঠ ।
বাংলাদেশ
থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বিদেশের
মাটিতে আমাকে আর আমার ভাইকে
শতভাগ বাঙালী করে তোলার আম্মার সে
কি প্রচেষ্টা। বিদেশের মাটিতে দীর্ঘ দিন থেকে ও
আম্মা মনে প্রাণে বাংলাকে,
বাংলার সাংস্কৃতিকে বুকে
ধরে আছেন।
আমেরিকার
ছোট্ট একটা শহরে আমি
আব্বা, আম্মা আর আমার ভাই
মিলে আমাদের বাস। আমেরিকা থাকলে
কি হবে আমাদের ঘরখানি
বাংলাদেশের ছোট্ট একটা ছবি হয়েছিলো।
ছোট বেলা থেকেই ৫২/৭১ এর গল্প
শুনে আসছি। কথা বলতে হতো
শুদ্ধ বাংলায়। প্রায় প্রতি উইকেন্ডে আমাদের বাসায় বাংলা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আসর হতো। হারমোনিয়াম বাজিয়ে
আম্মার গান সকলের সাথে
আমাদেরকেও মুগ্ধ করতো। কিন্তু আমরা যখন একটু
একটু করে বড় হতে শুরু করলাম তখন
থেকে বাংলা গান বাংলা সাংস্কৃতিক
সন্ধ্যা আমাদের কাছে অপছন্দ হতে
লাগলো। আমাদের অপছন্দকে পছন্দের করে তুলতে আম্মার
চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। আম্মা যতোই
চেষ্টা করছেন আমরা ততোই বিরক্ত
হতে শুরু করলাম। এমনটা চলতে
চলতে আমাদের সাথে আম্মার একটা
দূরত্ব বেড়ে গেল। আম্মার ভিতরে
অভিমান বাড়তে থাকলো।আম্মা আমাদের বুঝিয়েছেন, বকাঝকা করেছেন,এমন কি চড়
থাপ্পড় ও দিয়েছেন। আমাদেরকে বাংলার কৃষ্টি
সভ্যতার সাথে কোন ভাবেই
বেঁধে রাখতে পারলেন না।
আমাদের
বাসায় উইকেন্ডের প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে গেলো।
আব্বা সব সময় তাঁর
ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন । আম্মা থাকতেন
তাঁর ছোট্ট সংসার তাঁর উইকেন্ডের প্রোগ্রাম
আর কি করে আমাদের
বাঙালী করে রাখবেন সেই
নিয়ে। সে আমরা যখন
আস্তে আস্তে বাঙালী থেকে সরে আমেরিকান
হতে লাগলাম,আম্মা ও যেন বদলে যেতে শুরু
করলেন। আম্মার বদলে যাওয়া, তাঁর
অভিমান কোন কিছুই আমাদের
চোখে পড়েনি তখন ।আমরা নিজেদের মতো চলছি। আম্মাকে নিয়ে এতোটা ভাবতে হবে সেটাই আমরা
খেয়াল করি নাই। আম্মা যেনো
নিজের ভেতর গুটিয়ে
গেলেন । তারপর জীবন প্রবাহ চলতে
চলতে আব্বা কার এক্সিডেন্টে মারা
যাবার পর আম্মা পুরাই
নিস্তেজ হয়ে পড়েন। যে
আম্মা সব কিছুতে নিয়ম
মেনে চলতে বাধ্য করতেন
সেই তিনি আমাদেরকে আর
ভালো খারাপ কিছুই বলেন না। আমরাও
যেন আম্মার ওভার কন্ট্রোল থেকে
মুক্তি পেলাম।
আব্বা
মারা যাবার দুই বছর পর
ভাই যখন
আমেরিকান একটা মেয়েকে বিয়ে
করে নিয়ে এল,আম্মা একেবারেই
চুপচাপ, যেন কিছুই হয়
নাই। তারও বেশ কিছু
দিন পর একদিন ভাই
আম্মাকে ডেকে বল্লো সে
আলাদা বাসা ভাড়া করেছে।
তার বউকে নিয়ে নতুন
বাসায় উঠতে চায়। আম্মা
সে দিন ও বেশ
চুপচাপ। যেন কিছুই হয়নি।
একদমই আম্মা নিজের স্বভাব থেকে আলাদা হয়ে
গেলেন।
ভাই
চলে যাবার কিছুক্ষন পর বাসায় এসে
শুনতে পেলাম আম্মার কান্না। চিৎকার করে আম্মা কাঁদছেন।
এ প্রথম আমি আম্মাকে এতো
জোর কাঁদতে দেখলাম । আমি দরজা
ঠেলে আম্মার রুমে ঢুকলে,আম্মা
আমাকে দেখতে পেয়ে চোখ মুছে ওঠে
দাঁড়িয়ে বল্লেন কখন এসেছিস? খেয়ে এসেছিস?
না কি খাবার দিবো।
আমি আম্মার চোখে চোখ রাখতে
চাইলে আম্মা চোখে চশমা পরে
মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু দেখার
ভান করলেন।
সে
দিন প্রথম আমি আম্মার কষ্টের
হয়তো সিকি ভাগ অনুধাবন
করেছি।আম্মার জন্য প্রথম আমার
ভিতরে কন্যা সুলভ মনোভাব জাগ্রত
হলো। আমি আম্মাকে জড়িয়ে
ধরে বল্লাম- আম্মা আমি আপনাকে ছেড়ে
কোন দিন কোথাও যাব
না। আমার কথা শুনে বহু
কষ্টে বেঁধে রাখা মনকে আর
বেঁধে রাখতে পারলেন না। আমাকে শক্ত করে বুকে
জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমি আম্মাকে কাঁদতে
বাঁধা দিইনি। আম্মা কেঁদেই চলছেন, সাথে কাঁদছি আমি।
আমাদের দুই জনের চোখের
জলে সে দিন মা
মেয়ের দূরত্ব অর্ধেকটা কমে গেলো। আস্তে
আস্তে আম্মা আর আমার দূরত্ব
কমে,আমরা একে অন্যের
বন্ধু হয়ে গেলাম।
এবার
আম্মার নতুন চিন্তা। আমাক
ভালো বাঙালী ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া।
আমি সম্মতি দিয়ে সোজা বলে দিয়েছি- আম্মা আপনি যাকে পছন্দ
করবেন তাকেই বিয়ে করবো। আম্মা যেন নিজ কানকে
বিশ্বাস করতে পারলেন না।
কয়েকদিন পর পর আমাকে
জিজ্ঞাস করেন, ঠিক তো ? আমি
যাকে তোর জন্য পছন্দ
করবো তাকেই বিয়ে করবি? করবি তো? শেষে
দেখিস? আমি আম্মাকে আশ্বস্ত
করি। আপনি চিন্তা করবেন
না। আপনি পাত্র ঠিক
করেন। একদিন আম্মা ঠিকই আমার জন্য
পাত্র ঠিক করে ফেললেন।
আর আম্মার পছন্দের পাত্রের সাথে আমার বিয়ে
হয়ে গেল।
আমাদের
দিন গুলো ভালোই কাটছিল।
হঠাৎ একদিন আম্মা বাথরুমে পড়ে গিয়ে এই
দূরাবস্থা। আম্মা পুরা প্যারালাইজড হয়ে
পড়ে রইলেন।
আম্মাকে এখন দুইজন নার্স
এসে দেখাশোনা করে।ছুটির দিন আমি আর
আমার স্বামী মিলে আম্মাকে দেখাশোনা
করি। আজ ছুটির দিন। আম্মার আলমারী
থেকে সব কাপড় বের
করে গুছিয়ে দিতে লাগলাম। অনেকদিন
ভাবছিলাম,আম্মার আলমারী গুছিয়ে দিব, সময় করেতে
পারছিলাম না। আজ যে
করেই হোক গুছাবোই ঠিক
করলাম। গুছাতে গুছাতে আম্মার কাপড়ের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এলো একটা লাল রঙ্গের ডায়রি
পেলাম। কৌতুহল আটকাতে পারি নাই। আম্মার ডায়রির
পাতা উল্টাতে লাগলাম। প্রথম থেকে অনেক পৃষ্ঠা
অবধি গান লেখা। এরপরে
আমার নানা নানীর ছবি।
এরপর আম্মার একমাত্র ভাইয়ে ছবি। তারপর আব্বা
আম্মার বিয়ের ছবি।তার পর বেশ কয়েক
পৃষ্ঠা খালি। এর পর আম্মার
লেখা...
”দেশের
যে কি হবে কে
জানে। দাদা আর মিঠু
ভাই সেদিন কি সব যেন
বলছিলো। যুদ্ধ, ট্রেনিং। কেমন যে ভয়
ভয় লাগা কথাবার্তা। আমি
দাদা আর মিঠু ভাইয়ের
চা নিয়ে এলে আমাকে দেখে
ওরা চুপ হয়ে যায়।
পরে মিঠু ভাই যাবার
সময় আমি পথ আগলে
দাঁড়ালাম। কিরে রূপা পথ
ছাড়। দাদা আর আপনি
কি কথা বলছিলেন না
বল্লে পথ ছাড়বো না।
ও সব তুই বুঝবি
না। বড়দের কথা,
তুই ছোট মানুষ।আমি বুঝি
ছোট মিঠু ভাই? আমি
এবার ক্লাস এইটে ওঠেছি। মিঠু
ভাই হাসি দিয়ে চলে
গেলেন। সে আব্বার অফিস
থেকে ফিরে আম্মার সাথে
কি সব যুদ্ধ নিয়ে
কথা বলছিলেন। আমাকে কেউ কিছু বলছে
না। কিন্তু খুব খারাপ কিছু
একটা হতে যাচ্ছে। এটা
ঠিক বুঝা যাচ্ছে।
অনেক
দিন হয়ে গেল, স্কুল
যেতে পারছি না। স্কুলে এখন
কেউ আসে না। আব্বা
অফিস যাচ্ছেন না। দাদা আর
মিঠু ভাই ট্রেনিং নিতে
ইন্ডিয়া চলে গেল। যাবার
সময় মিঠু ভাই বলে
গেল , যদি বাংলাকে মুক্ত
করতে পারি, তবে তোর কাছে
ফিরবো। সে দিনের পর
থেকে মিঠু ভাইয়ের জন্য
বুকের কোথায় যেন শূণ্য শূণ্য
অনুভব হতে লাগলো। দাদার
জন্যও মন কেমন করে।
আম্মা তো সারা দিন
কেবল নামাজের বিছানায় বসে দাদার জন্য
কাঁদতে থাকেন। পুরো পরিবেশটাই কেমন
যেন গুমোট হয়ে আছে। ঢাকার
অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে গেছে যে
আব্বা আমাকে আর আম্মাকে নিয়ে
গ্রামে আমার মামার বাড়ি
গিয়ে উঠলেন। গ্রামের পরিবেশ প্রথম দিকে কিছুটা শান্ত
থাকলেও, কিছুদিন পর সেখানেও রাজাকার,
আর শান্তি কমিটির উৎপাত শুরু হয়ে গেলো।
মামীরা সারাদিন কেবল আম্মা আব্বাকে
বকাঝকা করতে লাগলেন। আমার
জন্যই নাকি তারা কেউ
রক্ষা পাবে না। ইতিমধ্যেই
আমার রূপের আগুন নাকি গ্রামময়
ছড়িয়ে গেছে।এই গ্রামে আর্মি মিলিটারী আসলে আর কোন
ভাবেই রক্ষা হবে না।
আমার
জীবনে হঠাৎ হঠাৎ কি
সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে,
আমি নিজেই কিছু যেন বুঝতে
পারছি না। মধ্যরাতে আম্মা
আমাকে ঘুম থেকে ডেকে
তুলে বল্লেন, রূপা তাড়াতাড়ি করে
গোসল করে রেডি হ।
আমি বল্লাম এতো রাতে গোসল
করবো কেন? রেডি হবো
কেন? কোথায় যাব? আম্মা বল্লেন
এতো কথা বলিস না।
এতো কথা বলার সময়
নাই। বিছানার উপর কাপড় গহনা
রাখা আছে পরে রেডি
হয়ে নে। দাদা আর
মিঠু ভাই যুদ্ধের ফাঁকে
আব্বা আম্মার সাথে দেখা করতে
এলেন,আব্বা দাদার সাথে আমাকে নিয়ে
চিন্তার কথা বলছেন। এ
সময় ভালো ছেলে কোথায়
পাবেন। আমাকে বিয়েটা দিতে পারলে হয়তো
আব্বার চিন্তা কিছুটা কমতো। সব শুনে মিঠু
ভাই দাদার কাছে আমাকে বিয়ে
করার আগ্রহ প্রাকাশ করল। আর তা
শুনে আব্বা আম্মা কিছুতেই দেরী করতে চাইলেন না।
সে রাতেই কাজি ডেকে মিঠু
ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে
হয়ে গেল।ভোর রাতের দিকে দাদা আর
মিঠু আমার স্বামী যুদ্ধে
ফিরে গেলো।আমার কাছে সব কিছু
কেবলই স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
আমাকে
রক্ষা করার এতো আয়োজন
এতো চেষ্টা। তবুও শেষ রক্ষা
হলো না।পাকিস্তানী মিলেটারি রাজাকার আর আলবদরদের সহযোগিতায় আমাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেল।
আব্বা বাঁধা দিতে গেলেন আর
গুলি খেয়ে লাশ হলেন দৌড়ে
এলেন মা তিনিও লাশ
হয়ে গেলেন...”
আম্মার
ডায়রি পড়ে আজ আমি
এ কোন সত্যের মুখামুখি
দাঁড়ালাম। আমার সমস্ত শরীর
কাঁপছে। ঘৃণায় শরীর রি রি
করছে।তারা না হয় ভিন্ন
দেশী পাকিস্তানী হানাদার কিন্তু রাজাকার আলবদর তো আমাদের দেশী,
বাঙালী আমাদেরই ভাই। তারা কি করে পারলো
নিজের বোন, বেটি, মাকে
হানাদারের হাতে সঁপে দিতে?
দেরিতে হলে ও বাংলাদেশের
সরকার এই জঘন্য কুখ্যাত রাজাকার
আলবদরদের বিচার করেছে। ধন্যবাদ বাংলাদেশ সরকারকে, সাবাস বাংলাদেশ। আমার আম্মার কলিজা কিছুটা
হলে ও শান্তি পেয়েছে
তাদের বিচারে।
আজ
বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবস।
আজ আমি আর আমার
স্বামী দু জন মিলে
আমাদের ছোট্ট ঘরটাকে লাল নীল সবুজ
হলুদ কাগজ দিয়ে বিজয়ের
সাজে সজ্জিত করে তুলেছি। আম্মাকে
একটু খুশি দেয়ার জন্য
বহু বছর পর আজ
আমরা আমাদের প্রতিবেশি কিছু বাঙালী ফ্যামিলিকে নিমন্ত্রণ করেছি। আমি আজ লাল
শাড়ী আর আমার স্বামী
সাদা পাঞ্জাবী পরেছে। আম্মার রুমে চাদর বিছিয়ে
হারমোনিয়া নিয়ে সুর তুলতে মনোযোগ
দিচ্ছি । “জয় বাংলা বাংলার
জয়” কতো বছর পর
আজ হারমোনিয়াম নিয়ে বসলাম।একটু পর আম্মার দিকে
চোখ পড়তেই দেখলাম আম্মা কেমন যেন ছটপট
করছেন। আম্মা যেন কিছু বলার
চেষ্টা করছেন। আম্মার চোখ দুটো লাল
হয়ে যেন বেরিয়ে আসতে
চাচ্ছে। আম্মা কিছু একটা বলার
আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে হঠাৎই
চিৎকার করে বলে উঠলেন
“জয় বাংলা”।