কমিউনিটি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন ‘খায়ের ভাই’

প্রয়াত হয়েছেন মাত্র ক'দিন হলো। অথচ; মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মুখে মুখে ফিরছে শুধু কর্মনিষ্ঠার কারণে। তিনি বাংলাদেশ সোসাইটির সহ-সভাপতি আব্দুল খালেক খায়ের। যুক্তরাষ্ট্রেরে তথা নিউইয়র্কের সববয়সী প্রবাসীদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘খায়ের ভাই’ নামেই। মানুষ ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়, কিন্তু নিজের সাধ্যদিয়ে সমাজের জন্য, দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে পারার চেষ্টায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। ছিলেন দায়িত্বের প্রতিও অবিচল।
একাধারে প্রবাসে কমিউনিটির পাশে এবং ধর্মীয় কর্মকান্ডেও সমানতালে সক্রিয় থাকার বিষয়টিও স্মরণ করছেন সবাই কমিউনিটির আড্ডা এবং সভাগুলোতেও। গত ১৩ নভেম্বর বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটি ইউএসএ ইনক্ এর উপদেষ্টা পরিষদ ও ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় মরহুম আব্দুল খালেক খায়েরের মাগফেরাত কামনায় দোয়া করা হয়। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন উপস্থিত সবাই।
একসাথে দীর্ঘদিন নিউইয়র্কে কমিউনিটির কল্যাণে কাজ করেছেন এমন সহযোদ্ধাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সংগঠনগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার কথা। কমিউনিটির প্রয়োজনে সববয়সীদের সাথে কাজ করেছেন নিরলসভাবে। প্রবাসে নোয়াখালীর সাথে আলাপচারিতায় তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন সেইকথা-
১৯৯৩ সাল, নিউইয়র্কে নিজ এলাকার মানুষদের নানা সংকটে-সহযোগীতায় একতাবদ্ধ হয়ে চলার নিরিখে গঠিত হয়েছিলো বেগমগঞ্জ সোসাইটি ইউএসএ ইনক্। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মরহুম আব্দুল খালেক খায়ের। তাঁর সহযোদ্ধা হিসাবে সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনকারী, বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটি ইউএসএ ইনক্ এর সাবেক সেক্রেটারি কমিউিনিটির আরেক প্রিয়মুখ তাজু মিয়া’র মতে- খায়ের ভাই ছিলেন মিশুক প্রকৃতির মানুষ। যখন যে সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন সেই সংগঠনকে এগিয়ে নিতে অবদান রেখেছেন। বেগমগঞ্জ সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় তিনি অন্যতম মূখ্যভূমিকা রেখেছিলেন বিদেশের মাটিতে বসবাসকারী এলাকার মানুষকে একটি ছাতার নিচে রাখা বাসনা থেকেই। উপজেলা পর্যায়ের একটি আঞ্চলিক সংগঠনের যাত্রা শুরু এবং নানা সংকটে ধৈর্য্যসহকারে প্রবাসীদের পাশে থাকার মতো দূরূহ কাজে তিনি ছিলেন সাবলিল।
বাংলাদেশ সোসাইটির নির্বাচন কমিশনারদের অন্যতম নোয়াখালী সোসাইটির ট্রাস্টি খোকন মোশারফ’র মতে দায়িত্বশীল সংগঠক হিসাবে “খায়ের ভাই” ছিলেন অতুলনীয়। একই সাথে সংগঠন পরিচালনায় আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহতায়ও তিনি নজীর স্থাপন করেছিলেন। মরহুম আব্দুল খালেক খায়ের সম্পর্কে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানালেন এমন অভিব্যক্তির কথা। দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ২০১৪ সালে বেগমগঞ্জ সোসাইটি ইউএসএ ইনক’র পুনর্গঠনেও এগিয়ে আসেন। খায়ের ভাই এবং তাজু ভাই (তাজু মিয়া) দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তাঁদের কাছে জমাকৃত ১৭ হাজার ডলার ২০১৪ সালে বেগমগঞ্জ সোসাইটির তখনকার আহবায়ক কমিটির কাছে হস্তান্তর করেন উনারা।
তরুন কমিউনিটি এক্টিভিস্ট ও বাংলাদেশ ক্লাব ইউএসএ’র সভাপতি নুরুল আমিন বাবু আর মরহুম আব্দুল খালেক খায়ের একই গ্রামের বাসিন্দা। দুই প্রজন্মের দুইজন কমিউনিটি এক্টিভিস্ট। কিন্তু ছোটদের মতামতকেও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতেন এবং এলাকার মানুষ হিসাবে নয় একজন বাংলাদেশী হিসাবেই প্রবাসীদের নিয়ে তিনি কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন খায়ের ভাই। এমন মন্তব্য নুরুল আমিন বাবুর।
বাংলাদেশ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকীর মতে- ‘খায়ের ভাই’ কখনো বয়সের তারতম্য দেখতেন না। সোসাইটিতে সবার মতামতকেই তিনি শ্রদ্ধা করতেন। সবার কাছেও তাঁর কথার গ্রহণযোগ্যতা ছিলো। তাঁর কাছ থেকে নিরীহ মানুষ উপকৃত হতো। কোন ব্যাক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানে দান অনুদানের জন্য মুক্তহস্ত ছিলেন। এলমহার্স্টে তাঁর কমিউনিটির মসজিদের জন্য যখন বাড়ি খোঁজা হচ্ছিলো তখন তিনি কোন ধরণের আর্থিক লাভ না নিয়েই নিজের ছেলের নামে কেনা বাড়ি ক্রয়মূল্যে মসজিদকে দিয়ে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সাংগঠনিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বেলায় যে কোন প্রয়োজনে তিনি পিছপা হতেন না। করোনার ভয়াবহ আঘাতে বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি কামাল আহম্মেদ ও সদস্য আজাদ বাকের ভাইকে হারানোর পর খায়ের ভাই শূণ্যতা পূরণে এগিয়ে আসতেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে কমিউনিটিতে একজন মুরুব্বীকে হারালো।
বৃহত্তর নোয়াখালী ইউএ ইনক্ এর সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান (মানিক) জানালেন- খায়ের ভাই ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সোসাইটিতে সহসভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সেখানে তিনি নোয়াখালীবাসীর ঠিকানায় পরিণত হন। এর আগেও বাংলাদেশ সোসাইটিতে নোয়াখালীর বাসিন্দাদের অনেকে দায়িত্ব পালন করেছেন কিন্তু খায়ের ভাই ব্যাতিক্রম ছিলেন। পদ নয় প্রবাসীদের কল্যাণ ছিলো তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বাংলাদেশ সোসাইটির থেমে থাকা নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য সবাই চাপাচাপি করলেও তিনি রাজি হননি। আমরা সমসাময়িক সময়ে আমেরিকায় এসেছিলাম। কমিউনিটির বিভিন্ন প্রয়োজনে একসাথে কাজ করতে গিয়ে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সর্বশেষ বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির ভোটার নিববন্ধনের শেষ দিনে রাত ১টা পর্যন্ত তিনি সোসাইটি অফিসে কাটিয়েছেন সবার সাথে।
নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সক্রিয় রয়েছেন এমন সববয়সীদের কাছে মরহুম আব্দুল খালেক খায়ের একজন বন্ধুবৎসল মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। প্রবাসে নোয়াখালীর সাথে আলাপচারিতায় তাঁর দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা কমিউনিটি এক্টিভিস্টর জানিয়েছেন এমন কথাই। আল্লাহ যেনো তাঁকে জান্নাতবাসী করেন সেই কামনাও করেন সহযোদ্ধারা।
প্রসঙ্গত ঃ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মরহুম আব্দুল খালেক খায়েরে। সোনালী ভবিষ্যৎ গড়তে আশির দশকে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। নিজ এলাকার প্রবাসীদের কল্যাণে আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তোলার অগ্রপথিক ছিলেন তিনি। বৃহত্তর বেগমগঞ্জ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন, বর্তমানে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। বৃহত্তর নোয়াখালী সোসাইটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ২০১৬ সাল থেকে তিনি প্রবাসীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ইউএএস’র সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৯ নভেম্বর সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরদিন মঙ্গলবার বিকালে লং আইল্যান্ডের ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালে দ্বিতীয় নামাজে জানাযা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।