নিউইয়র্কে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে উপচে পড়া ভীড়
স্রোত নেমেছে দেশগামী রেমিটেন্সে
রমজান, ঈদ কিংবা যেকোন উৎসবে প্রবাসীদের নিজেদের খরছের বাজেটে একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে দেশে স্বজনদের জন্য। তাই; কস্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে স্বজনদের মুখে হাসি ফুটানো প্রবাসীদের পদচারনায় এখন সরগরম অন্যতম শীর্ষ রেমিটেন্স প্রেরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির মানি এক্সচেঞ্জ এবং মানি ট্রান্সফার এজেন্টের অফিস ও দোকানগুলোতে । যেনো স্রোত নেমেছে দেশে রেমিটেন্স প্রেরণে।
কথা বলার ফুসরত নেই এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তাদের । সকাল থেকে রাত অবদি মানি এক্সচেঞ্জে গ্রাহকদের উপচে পড়া ভীড়। স্বাস্থ্যবিধি মানতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে এক্সচেঞ্জগুলোর গ্রাহক লাইন ফুটপাতে গিয়ে ঠেকছে প্রতিনিয়ত। রমজানের খরছ, ঈদের খরছ পাঠানোর পর এখন শেষমুহর্তে যাকাত, ফিতরা এবং আল্লাহ’র ওয়াস্তে দেওয়ার জন্য টাকা পাঠানোর শেষ সময়ের ব্যস্ততা।
প্রতি মাসের নিয়মিত খরছের বাইরে রমজান এবং ঈদে দেশে বাড়তি টাকা পাঠাতে হয়। তারওপর দেশে লকডাউন চলার কারণে অনেক পরিবারে আয় কমে গেছে। তাছাড়া দুই শতাংশ নগদ আর্থিক প্রণোদনার কারণে প্রবাসীরা বৈধপথে রেমিটেন্স প্রেরণে বেশী আগ্রহী। তাই বাড়তি চাপ সামলাতে হচ্ছে বলে মনে করছেন মানি এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তা এবং অর্থপ্রেরণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এজেন্টরা। সবচে; বড়কথা দ্রুত স্বজনদের কাছে অর্থ পৌঁছাতে পেরে প্রবাসীরাও খুশি। তবে; সুযোগ বুঝে কোন কোন এজেন্ট রেমিটেন্স প্রেরণের ফি বাড়িয়ে দেওয়ায় লাভের গুড় পিপড়ায় খাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সোমবার বিকালে কুইন্সের ওজনপার্কের সোনালী এক্সচেঞ্জে গিয়ে দেখা যায় ভেতরে গ্রাহকদের লম্বা লাইন। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার কারণে সেই ভীড় দীর্ঘ হয়ে ফুটপাতেও লাইনে পরিণত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী এ্যংকর ট্রাভেলস্ এর অফিসেও একই অবস্থা। কাছাকাছি স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেসেও গ্রাহকদের ভীড়। একই অবস্থা স্থানীয় মানি ট্রান্সফার কোম্পানীর এজেন্টদের কাছেও।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার অধিবাসী মোঃ তাজুল ইসলাম প্রায় ১১ বছর ধরে ব্রুকলিনের ইস্ট নিউইয়র্কে বসবাস করেন। জানালেন- রমজানের আগেই ইফতারসহ আনুষাঙ্গিক খরছের জন্য এবং এখন ঈদের জন্য মিলিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান, মাসহ স্বজনরা রয়েছেন দেশে।র হয়তো আরো পাঠাতে হতে পারে।
তিনি জানালেন, দুইদিনের মধ্যে একাউন্টে এবং ক্যাশ পিকআপ হলে ২৪ ঘন্টায় স্বজনরা টাকা তুলতে পারে। দুই শতাংশ প্রণোদনার কারণে দেশে স্বজনরা কিছুটা হলেও বেশী টাকা তুলতে পারে। কিন্তু এখানে এজেন্টরা মাঝে মাঝে অতিরিক্ত ফি নেয়। তাঁর মতে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখে তাই টাকা পাঠানোর ফি না থাকলেই ভালো হতো।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বাসিন্দা হাসান রমজানের নিয়মিত খরছ প্রেরণের পাশাপাশি এখন যাকাতের টাকা পাঠাচ্ছেন স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস থেকে। তিনি জানান- দেশে দরিদ্র স্বজন, দ্বিনী প্রতিষ্ঠিান এবং অসহায় মানুষদের মাঝে সেই টাকা পৌঁছাতে হবে। তাই; শেষমুহুর্তে মানি এক্সেচেঞ্জে এসেছেন তিনি।
সিলেটের গোলাপগঞ্জের অধিবাসী মোঃ জিয়াউদ্দিন (৫১) ১৩ বছর ধরে পরিবার নিয়ে থাকেন ওজন পার্কে। দেশে মা-বাবাসহ স্বজনরা রয়েছেন। রমজানে খরছের জন্য ৩০ হাজার টাকা আর সোমবার ঈদের খরছের জন্য পাঠালে ৭০ হাজার টাকা। পিতা-মাতা ও ভাইবোনসহ ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এই টাকা পাঠিয়ে যারপরনাই খুশি এই প্রবাসী। নিয়মিতই তিনি বাড়িতে টাকা পাঠান। তবে; রমজান, ঈদ কিংবা যেকোন উৎসবে বাড়তি টাকা পাঠিয়ে থাকেন তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডের সোনালী এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা ওয়াহিদের সাথে। দম ফেলানোর ফুসরত নেই তাঁর। ব্যাস্ততার ফাঁকে শুধু বললেন- দুই শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণার পর বৈধপথে দেশে টাকা পাঠানো বেড়েছে। তবে; গত দুই সাপ্তাহে চাপ বেড়েছে অনেক। প্রতিদিনই গ্রাহকদের ভীড় বাড়ছে, চাঁদ রাত পর্যন্ত কয়েকগুন বাড়বে এই ভীড়। তাঁর সামনের গ্রাহকদের ভীড়ের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং যোগাযোগের নাম্বার দিয়ে বাড়তি তথ্যের জন্য প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করার জন্য বিনয়ের সাথে অনুরোধ করেন তিনি।
ঘুরে দেখা গেছে- নিউইয়র্কে বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে কুইন্সের জ্যাকসন হাইটস্, জামাইকা হিলসাইড, ওজন পার্ক, ব্রুকলিনের চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড, ফুলটন এবং ব্রংকসের পার্কচেস্টার-স্টারলিংয়ের অর্থপ্রেরণকারী বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহকদের ভীড়। রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সোনালী এক্সচেঞ্জ, বিএ-এক্সচেঞ্জ, স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেসসহ দেশীয় মানি এক্সচেঞ্জগুলো ছাড়াও চয়েস, রিয়া, ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানি ট্রান্সফার কোম্পানির এজেন্ট নিয়ে টাকা পাঠানোর কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশীদের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানেও গ্রাহকদের ব্যাপক ভীড় লক্ষ্য করা গেছে।
তাজুল ইসলাম কিংবা জিয়া উদ্দিনই নয় প্রতিদিন মানি এক্সচেঞ্জ অথবা মানি ট্রান্সফার কোম্পানির এজেন্টদের অফিসে প্রবাসীদের ব্যাস্ততা দেশে স্বজনদের জন্য টাকা পাঠানো নিয়ে। একসময় জ্যাকসন হাইটস্, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড কিংবা জ্যামাইকার মতো ব্যাস্ততম এলাকাগুলোতে একচেঞ্জে যেতে হতো। এখন মানি এক্সচেঞ্জগুলোর শাখা বেড়েছে এবং মানি ট্রান্সফার কোম্পানিগুলোর এজেন্ট রয়েছে ঘরের পাশের এমন বাঙালী গ্রোসারি থেকেও টাকা পাঠানো যাচ্ছে। নিউইয়র্ক সময় সন্ধ্যায় ক্যাশ-পিকআপের মাধ্যমে টাকা জমা দিলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শুধুমাত্র পিন নাম্বার এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যাবহার করে বাংলাদেশে সকাল বেলায় টাকা তুলতে পারে।
কস্টার্জিত অর্থ স্বজনদের কাছে প্রেরণের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন তরুন ও যুবকরা। যাদের বেশীরা ভাগই একা (ব্যাচেলর) থাকেন। সোমবার বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠান এক ডলারের বিপরীতে ৮৫ দশমিক ১০ টাকা দাম নির্ধারণ করে। একাউন্টে পাঠাতে ব্যাংক ভেদে এই তারতম্য ঘটে। একইভাবে ক্যাশ পিকআপে কিছুটা কম পাওয়া যায় বলে জানানো হয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
রেমিটেন্সের বাংলাদেশগামী এই স্রোত ঈদ পর্যন্ত আরো তীব্র হবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস-ওজন পার্কের কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ হোসেন তুহিন। নিয়মিত ব্যাস্ততার বাইরে ২য় রমজান থেকে তাঁদের এখানে গ্রাহকদের চাপ বাড়ছে। বৈধপথে দেশে অর্থপ্রেরণে দুই শতাংশ প্রণোদনাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন তিনি।
এ্যাংকর ট্রাভেলেস্’র পরিচালক তাছলিমা বেগম জানান- তাঁদের গ্রাহকদের বেশীরভাগই নোয়াখালী এবং সিলেট অঞ্চলের। এরবাইরে ঢাকার একাউন্টগুলোতেই বেশী টাকা পাঠানো হয়। কারণ ঢাকায় সারাদেশের মানুষ বাস করে থাকেন। মার্চের শেষ সাপ্তাহ থেকে তাঁদের এখানে চাপ বেড়েছে, প্রতিদিনই গ্রাহকদের ভীড় বাড়ছে।