নিউইয়র্কের ওজনপার্কে আবারো বাংলাদেশী খুন
রাস্তায় রক্তের স্রোত ॥ কমিউনিটিতে ক্ষোভ, আতংক

সাইডওয়ার্ক ঘেঁষে রাস্তায় রক্তের স্রোত লেগে আছে, তখনো শুকায়নি। স্কুলফেরৎ শিশু-কিশোররা তাজা রক্ত দেখে কিছুটা ভড়কে যাচ্ছে। আর অভিভাবকরা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ভয় এড়াতে। রাস্তার বিপরীত পাশে ‘মসজিদ আল আমান’ এর সামনে ১০-১২জন বাংলাদেশী একটি বাংলা ভাষার টিভি চ্যানেলের লাইভে স্বাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জনপ্রিয় দুটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাও পৌঁছে। উপস্থিতদের চোখেমুখে ক্ষোভ আর উৎকন্ঠা। অথচ; আশপাশে শুনশান নিরবতা, যেনো কিছুই হয়নি।
৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুর দুইটায় নিউইয়র্কের ওজনপার্কের সিটিলাইনে ২০০ ফরবেল স্ট্রিটের বাসার সামনের চিত্র ছিলো এমনই। ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দিবাগত রাত একটার কিছুসময় আগে এইবাসার সামনেই নির্মমভাবে খুন হন বাসার বাসিন্দা প্রবাসী বাংলাদেশী মুদাচ্ছির খন্দকার (৩৬)। লিবার্টি এভিনিউ এবং গ্লেনমোর এভিনিউর মধ্যবর্তীস্থানে ফরবেল স্ট্রিটের এই জায়গাটিতে সবসময় মানুষজন চলাচল করে। এরকম একটি ব্যাস্ততম সড়কে এবং ওজনপার্কে বৃহত্তর মসজিদের সামনে এই হত্যাকান্ডকে ‘পরিকল্পিত খুন’ হিসাবে দেখছে বাংলাদেশীরা।
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে তিনি জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে কাজ শেষে নিজের গাড়িতে করে বাসার সামনে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে নামার সময় দুর্বত্তরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে চলে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁকে দ্রুত উদ্ধার করে জামাইকা হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এনিয়ে কমিউটিতে ক্ষোভ ও আতংক প্রশমিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে স্থানীয় মসজিদগুলোর পরিচালনা কমিটি এবং মুসুল্লীদের সাথে কথা বলেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে দ্রুত অপরাধীকে গ্রেফতার এবং তদন্তের মাধ্যতে হত্যাকান্ডের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার।
এদিকে হত্যাকান্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে বুধবার ভোর থেকেই মুদাচ্ছিরের সহকর্মী, বন্ধু ও প্রতিবেশীরা ভীড় করতে থাকেন বাড়ির সামনে। তাঁরা জানান, এলাকায় তিনি পরিচিত ছিলেন জিতু নামে। পরিবার পরিজনের সাথে গত’ক বছর তিনি এই এলাকায় বসবাস করতেন। স্ত্রী, চার বছরের এক ছেলে, মা-বাবা ও ছোট ভাইসহ তিনি এ বাসায় থাকতেন। বাংলাদেশে তাঁদের বাড়ির মানিকগঞ্জে।
সহকর্মী এম এ গফুর খান ও মাহবুব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন- নিহত মুদাচ্ছির খন্দকারের কোন শত্রু থাকতে পারেনা। কারো সাথে শত্রুতার মতো ব্যাক্তি ছিলেন না তিনি। জেএফকে এয়ারপোর্টে কর্মরত বাংলাদেশীদের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিলো। যেকারো সমস্যা কিংবা বিপদে ছুটে আসতে। মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করে নিজের নতুন কেনা গাড়িতে করেই তিনি বাসায় ফিরেন।
তাঁরা জানান, গাড়ির দরজা সামান্য খোলার পরই দুবৃত্তরা খুব কাছ থেকে গুলি করে চলে যায়। এসময় গুলির শব্দে প্রতিবেশীরাও হতচকিত হয়ে উঠে। খবর দেওয়া হলে দ্রুত পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে। এসময় তাঁর স্ত্রীর চিৎকারে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। জামাইকা হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করে। সকালে তাঁরা এসে গাড়ির দরজা খোলা দেখতে পান। আলামত হিসাবে পুলিশ গাড়িটি নিয়ে গেছে।
উপস্থিত প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের ভাষ্য মতে গাড়ি ছিনতাইয়ের চেষ্টা হয়নি, তাঁর কিছুই খোয়া যায়নি। দুবৃত্তদের গাড়টি রাখা ছিলো ঘটনাস্থলের কাছে গ্লেনমোর এভিনিউ এবং ফরবেল স্ট্রিটের কোনায়। হত্যাকারীরা মুখোশ পরিহিত ছিলো। মুদাচ্ছিরকে গুলি করার পর ঘাতক নির্বিঘেœ হেঁটে গিয়ে গাড়িতে চেপে বসে সটকে পড়ে।
ওজনপার্ক সিটি লাইনের এই এলাকাসহ আশাপাশ বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের (হেইট ক্রাইম) অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে বলে ক্ষোভ ঝেড়েছেন হত্যাকান্ডস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশী ও আশাপাশের বাড়ির বাসিন্দারা। প্রায়শই টিএলসি গাড়ীর কাঁচ ভাংচুর করে লুটপাট, ছিনতাই, মারধর আর হামলার বিষয়টি উল্লেখ করছেন কেউ কেউ। আর সবাই বারবার টেনে আনেন ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট স্থানীয় আল ফোরকান জামে মসজিদের ইমাম আলাউদ্দিন আকুঞ্জি (৫৫) ও তার সঙ্গী মুসুল্লী তারা উদ্দিন মিয়ার (৬৪) প্রকাশ্যে হত্যাকান্ডের বিষয়টি।
মুদাচ্ছিরের হত্যাকান্ডের বিষয়ে কথা বলতে ২০০ ফরবেল স্ট্রিটের বাসায় গেলে গণমাধ্যমের সাথে কেউ কথা বলতে রাজী হননি। সমবেদনা জানাতে সেখানে গেছেন নিউইয়র্কের কনসাল জেনারেল ড. মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
প্রতিবেশী ও বাড়ির মালিক নজরুল ইসলাম জানান- তাঁর বাড়ির সিসি ক্যামরায় দেখা গেছে গুলির ঘটনার পর একজন মুখোশ পরিহিত ব্যাক্তি গিয়ে গাড়িতে উঠে। তিনি জোর দিয়ে বলেন এটি কোন ছিনতাই কিংবা অন্যকিছু নয়। এটি হেইট ক্রাইম। তিনি মুদাচ্ছিরকে চিনতেন। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। প্রায় এখানে বাংলাদেশীরা মারধর ও হামলার শিকার হয়ে থাকে।
বুধবার রাতে কথা হয় ঘটনাস্থলের বিপরীত দিকে অবস্থিত মসজিদ আল আমান’র সেক্রেটারি মোঃ শরিফের সাথে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন- এশার নামাজের পর আহূত মসজিদ কমিটি এবং মুসুল্লীদের সাথে পরামর্শ সভা চলছে এবিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে। তবে; পুলিশ মসজিদের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে গেছে। তদন্ত করে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছে। তাঁর মতেও এটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। কারণ মুদাচ্ছিরের কিছুই খোয়া যায়নি।
এদিকে মুদাচ্ছির হত্যাকান্ডের ফলে ওজনপার্কে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে ক্ষোভ ও আতংক কমাতে পুলিশের তৎপরতার অংশ হিসাবে মসজিদ কমিটি ও মুসুল্লীদের সাথে কথা বলে এনওয়াইপিডির কর্মকর্তারা। ৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার মাগরিবের নামাজের পর ফুলতলি মসজিদে আসেন ১০২ প্রিসেন্টের পুলিশ কর্মকর্তারা। তাঁরা মসজিদের সামনে মুসুল্লী এবং কমিটির নেতৃবৃন্দকে আশ্বস্ত করেন নিয়মিত টহল জোরদার করা হবে এবং যেকোন প্রয়োজনে পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখতে অনুরোধ করেন বলে জানান মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি মোঃ জামাল হোসাইন।