বসন্ত নেমেছে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণে

ওজনপার্কের এ্যাংকর ট্রাভেলস্ টাকা প্রেরণে করতে আসা প্রবাসী।

নিউইয়র্কের প্রকৃতি রুক্ষতা হারিয়ে সবুজের পথে। গাছগাছালিতে পাতা গজাচ্ছে, আসছে ফুলও। প্রকৃতিতে বসন্তের এই আগমি বার্তার মতোই বসন্ত নেমেছে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণেও। রমজান এবং ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে দেশে টাকা পাঠাতে মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে প্রবাসীদের ভীড় সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। ঈদ ঘনিয়ে আসার পূর্বে এই ভীড় আরো বাড়বে। কারণ; ঈদ কিংবা যেকোন উৎসবে প্রবাসীদের নিজেদের খরছের বাজেটে একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে দেশে স্বজনদের জন্য।

রমজানের পূর্ব থেকে মাসের খরছের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠানোর সাথে রমজানের খরছ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। এরসাথে এখন যুক্ত হচ্ছে যাকাত, ফিতরা এবং রমজানের মেজবান খাওয়ানোসহ নানান উপলক্ষের টাকা পাঠানো। রেমেটেন্স প্রেরণ ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চে বেড়েছে। ঈদের খরছ পাঠানো শুরু হলে এপ্রিলে এটি দ্বিগুন হতে পারে। যা করোনা পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায়ও প্রায় দ্বিগুন। এমনটি জানা গেছে মানি এক্সচেঞ্জ এবং টাকা প্রেরণকারীদের সাথে কথা বলে। 

এদিকে দেশে টাকা পাঠাতে বাংলাদেশী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখতে গিয়ে দামের দিক থেকে ঠকতে হচ্ছে প্রবাসীদের। আবার ডলারের বিপরীতে দাম ভালো দিলেও মানি এক্সচেঞ্জ এজেন্টদের কাছে টাকা পাঠানোর ফি বেশী এমনটিও এমন অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংকগুলো বলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেওয়া বিনিময় হার (রেট) তাঁদেরকে অনুসরণ করতে হয়। অপরদিকে ভালো রেট দিচ্ছেন, কিন্তু সে তুলনায় ফি বেশী নয় এমন দাবিও আছে এজেন্টদের। তবে; প্রশান্তির পরশ হচ্ছে আড়াই শতাংশ প্রণোদনার অর্থ। 

ঘুরে দেখা গেছে- নিউইয়র্কের বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে কুইন্সের জামাইকা হিলসাইড, জ্যাকসন হাইটস্, ওজন পার্ক, ব্রুকলিনের চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড, ইউক্লিড, ফুলটন এবং ব্রংকসের পার্কচেস্টার-স্টারলিংয়ের অর্থপ্রেরণকারী বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহকদের ভীড়। মোবাইল এক্সেসরিজ দোকান, গ্রোসারি কিংবা ফার্মেসিতেও মানি ট্রান্সফার কোম্পানীগুলোর এজেন্ট নিয়ে টাকা পাঠানো হচ্ছে। এসব এজেন্ট থেকে গ্রাহকদের মুঠোফোনে বাড়তি রেটের আকর্ষণ দিয়ে ম্যাসেজ যাচ্ছে প্রায়শই। 

রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সোনালী এক্সচেঞ্জ, ব্যাংক এশিয়ার বিএ-এক্সপ্রেস, স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেসসহ দেশীয় মানি এক্সচেঞ্জগুলো ছাড়াও চয়েস, রিয়া, ওয়েস্টার্ণ ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মানি ট্রান্সফার কোম্পানির এজেন্ট নিয়ে টাকা পাঠানোর কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশীদের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানেও গ্রাহকদের ব্যাপক ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিদিন দুপুর থেকে ইফতারের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত প্রবাসীদের ভীড় জমে থাকেফেব্রুয়ারির তুলনায় এ ভীড় দ্বিগুন হয়েছে এবং ঈদকে সামনে রেখে এই ভীড় আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন মানি ট্রান্সফার এজেন্টরা।

কুইন্সের ওজনপার্কের এ্যাংকর ট্রাভেলসে গিয়ে দেখা যায় এক ডলারের বিপরীতে রেট দেওয়া হচ্ছে ৮৯ টাকা। অথচ; পার্শ্ববর্তী সোনালী এক্সেচেঞ্জে রেট দেওয়া হচ্ছে ৮৭ টাকায়। কোন কোন মানি এক্সচেঞ্জ ৮৯ টাকা ৩০-৩৫ পয়সা অপার করছে গ্রাহকদের। তবে; রেট ভালো দিয়ে ফিও বাড়িয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে গ্রাহকদের।

এদিকে রেট কম হলেও ভীড়ের কমতি নেই রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী এক্সেচেঞ্জে। গ্রাহকরা বলছেন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখতে গিয়ে তাদেরকে প্রচলিত দরের চেয়ে ২টাকা করে কম পেতে হচ্ছে তাঁদের। তবে; তাঁরা যে কোন ব্যাংকেই সমান রেট পেয়ে থাকেন। মানি ট্রান্সফার কোম্পানীগুলো সকল ব্যাংকে সমান রেট দেয়না। আবার ফিও নিচ্ছে বেশী। 

মানি ট্রান্সফার এজেন্টে টাকা পাঠাতে আসা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বললেন- ক্যাশ পিকআপ হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই পরিবারের সদস্যরা টাকা তুলতে পারে রেটও ভালো পাওয়া যায়। ব্যাংকে জমা হতে দুইদিন লাগে। আড়াই শতাংশ প্রণোদনার কারণে কিছুটা হলেও বাড়তি টাকা পাওয়া যায়। 

সোনালী এক্সচেঞ্জ কর্পোরেটশ ইনক্ সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে রেমিটেন্স প্রেরণের প্রবাহ বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ১১ মিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স প্রেরিত হয় সোনালী এক্সেচেঞ্জের মাধ্যমে। মার্চে প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমান ছিলো সাড়ে ১৩ মিলিয়ন ডলার। এপ্রিলে এটি প্রায় দ্বিগুন হতে পারে। রেমিটেন্স প্রবাহ ২০২০ সাল অর্থাৎ করোনার পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় খুবই ভালো। তবে; ২০২১ সালের তুলনায় গড়পড়তা। 

ফেব্রুয়ারির তুলনায় এপ্রিলে দেশে অর্থপ্রেরন দ্বিগুন হতে পারে বলে মন্তব্য করেন এ্যাংকর ট্রাভেলস্ এর কর্ণধার এ এস এম মাঈন উদ্দিন পিন্টু। ফি বেশী নেয়ার অভিযোগ ব্যাখ্যা করে তিনি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে বলেন- ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যায় নির্বাহ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। অথচ; এজেন্টদের যাবতীয় ব্যায় তাদেরকে বহন করতে হয়। তাছাড়া এজেন্টরা রেট ভালো দিয়ে থাকেন। গ্রাহকরা সময়মতো টাকাও পাচ্ছেন। প্রণোদনাতো আছেই। তিনি টাকা পাঠানোর ফির তালিকা দেখিয়ে বলেন- অনেকে আরো বেশী নিয়ে থাকেন।

আস্থা রাখতে গিয়ে গ্রাহকদের দুই টাকা করে ডলার প্রতি কম প্রাপ্তির অভিযোগ স্বীকার করেন সোনালী  এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দেবশ্রী মিত্র। রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া রেট অনুসরণ করে। আর সোনালী ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাঁদের যে রেট নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তা অনুসরণ করতে হয়। এর বাইরে তাঁদের কিছু করার থাকেনা। তবে; বিষয়টি তিনি প্রধান কার্যালকে অবহিত করেছেন বলে আশ্বস্ত করেন।

পাল্টা যুক্তি দিয়ে সোনালী এক্সেচেঞ্জের এই কর্মকর্তা বলেন- সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশের যে কোন ব্যাংক একাউন্টে টাকা প্রেরণে সমান রেট দিয়ে থাকে। তাছাড়া টাকা প্রেরণের ফিও মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় কম। সেটিও কিন্তু দেখা উচিৎ। তিনি আশা করেন 

প্রসঙ্গঃ যুক্তরাষ্ট্র এখন অন্যতম শীর্ষ রেমিটেন্স প্রেরণকারী দেশ। প্রতিনিয়ত বাড়ছে বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যা সেই তুলনায় এখানে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ব্যাংকগুলোর ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার নির্ধারণে পিছিয়ে থাকে। ফলে ঠকতে হয় গ্রাহকদের।

মন্তব্য লিখুন :