নিউইয়র্ক নগরজুড়ে সব্জি আবাদে গৃহস্থ্যের ব্যস্ততা

নিউইয়র্ক সিটির ওজনপার্কে বাড়ির আঙিনায় আবাদকৃত ছোট্ট কৃষি খামার পরিচর্যা করছেন উদ্যোমী যুবক জহিরুল হক।

আলো ঝলমলে পূঁজির শহর নিউইয়র্কের ছোট ছোট বাড়িগুলোতে এখন সবুজের সমারোহ। একেকটি বাড়ি যেনো একটি কৃষি খামার। প্রতিবছরের ন্যায় গ্রীস্মের এই সময়ে নানান জাতের সব্জিতে ভরপুর বাড়িগুলো। নগরজুড়ে সব্জি আবাদ আর ফসল তোলায় এখন ব্যাস্ত গৃহস্থ্যরা। অবশ্য এই ব্যস্ততা এশীয়দের মাঝেই বেশী। বাংলাদেশীদের বাড়িগুলোর উঠানে, সামনের পার্কিং লট কিংবা বাড়ির সাইডওয়ার্কের পাশের ছোট্ট পরিসরের শাক-সব্জির বাগানে যেনো গ্রামীণ কৃষির প্রাণ আঙিনায় সব্জিচাষের চিরায়ত রূপ ফুটে উঠে।

তবে; মওসুমের শুরুতে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে গৃহস্থ্যদের। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে বসন্তের শেষ দিকেও তীব্র ঠান্ডায় বারবার সব্জির বীজতলা নস্ট হয়েছে অনেকের। একাধিকবার শাকের বীজ লাগানোর পরও তা গজিয়ে উঠতে সময় নেয়। তবে; যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে বৈরী আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেয়ার, তাঁদের বেগ পেতে হয়নি বলেও মনে করেন অনেকে। বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বীজ, চারা এবং উৎপাদিত শাক-সব্জি সামাজিক উপহার হিসাবেও সমাদৃত হচ্ছে।

ঘুরে দেখা গেছে- নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটস্, এলমহার্স্ট, এস্টোরিয়া, জ্যামাইকা, সাউথ জ্যামাইকা, রিচমন্ডহিল, ওজনপার্ক, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড, ইস্ট নিউইয়র্ক, পার্কচেস্টারসহ বাঙালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কিংবা যেখানেই বাংলাদেশীরা বাড়ি কিনেছেন সেখানেই শাক-সব্জির আবাদ করেছেন। শিমের লতা কিংবা লাউ’র ডগা ছড়িয়ে পড়ছে বাড়ির সীমানা প্রাচীর টপকে। গাছে ঝুলছে বেগুন, পাক ধরছে টমেটোতে, কাঁচামরিচ, বরবটি, শসা, কচু, গ্রীনপেপারও তোলার অপেক্ষায়। ফুল এসেছে করলা, কুমড়া গাছে। 

এই অবস্থা শুধু বাংলাদেশীদের বাড়িগুলোতে নয়। পুরো নিউইয়র্ক সিটিতে ভারতীয়, পাকিস্তানী, চাইনিজসহ এশীয়দের বাড়িতেও একই অবস্থা। অন্যরা টবে হলেও ন্যুনতম একটি-দুটি সব্জির চারা লাগিয়েছেন। যেনো তাজা শাক-সব্জি খাওয়া থেকে কেউই বাদ যেতে চায়না। সব্জির চাষ পদ্ধতি আবার প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন। যার মধ্যদিয়ে ফুটে উঠে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বকীয়তাও।

আবাদকারী বাংলাদেশী পরিবারগুলোর সাথে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ছোট্ট পরিসরের জায়গায় শাক আবাদ দিয়ে শুরু হয়। কিন্তু এবার প্রচন্ড শীতের কারণে বীজ গজায়নি প্রথম দিকে। একইভাবে সব্জির বীজ তলাও নষ্ট হয়েছে। গাছ গছানোর পর মরে যায়, আবার গছালেও বাড়তে সময় নেয় অনেক। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে প্রায় একমাস পর শাক গজানো শুরু হয়। তখন প্রতিবেশী ও স্বজনরা অনেকে একে অপরকে বীজ ও চারা দিয়ে সরবরাহ করে সহযোগীতা করেছেন বিপুল উৎসাহে।

প্রথম দিকে মুলা শাক, লাল শাক, পাট শাক, ধনিয়া আবাদ করা হয়। শাক তোলার পর আবার ডাটা শাক, পুঁই শাক, কচু, স্পিনাশ (পালং), কলমি শাক আবাদ করেন অনেকে। ঠান্ডার কারণে দেরীতে হলেও জুনের প্রথম দিকে শুরু হয় সব্জির চারা তৈরীরা কাজ। তবে; এবার যারা গ্রোসারি থেকে চারা কিনে লাগিয়েছেন তাঁরা দ্রুত ফলন পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ বাড়ির পেছন কিংবা সামনের উঠানের পাশাপাশি অনেকে টব, বালতি কিংবা প্লাস্টিকের বাকেটেও লাগিয়েছেন। 

আবাদি সব্জিসমূহের মধ্যে বিভিন্ন জাতের মরিচ, লাউ, বিভিন্ন জাতের কুমড়া, বিভিন্ন জাতের টমেটো, বিভিন্ন জাতের বেগুন, শসা, শিম, করলা, বরবটি, ঢেরস, নানান জাতের বেল পেপারই বেশী। তবে; পেঁয়াজ, ফুল কপি, পাতা কপি, আলু, সাজনাসহ ব্যাতিক্রমী সব্জিও লাগিয়েছেন গৃহস্থ্যরা। রোজ দুই বেলা পানি দেয়া, সময় করে ভিটামিন (সার) দেয়া, জমি নিঙড়ানো, মাচা তৈরীসহ আনুষাঙ্গিক কাজে ব্যাস্ততা চোখে পড়ার মতো। শাক তোলার পর এখন সব্জি তেলায়ও ব্যাস্ততা রয়েছে। 

দুই দশক ধরে গ্রীস্মকালে নিজের বাড়ির আঙিনায় শাক-সব্জির আবাদ করেন ওজনপার্কের ৮৮ স্ট্রিটের বাসিন্দা মুহাম্মদ আব্দুস সালাম। শীতের তীব্রতায় মওসুমের শুরুতে বেগ পেতে হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। টবে এবং মাটির বেডে মিলিয়ে ১৪ জাতের শাক ও সব্জির আবাদ করেন তিনি। শাক তোলার পর্ব শেষ হয়েছে জুনেই। এখন সব্জির গাছগুলোতে ফুল এসেছে, তোলার সময় হয়ে এসেছে। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি স্বজনদের মাঝেও বিতরণ করেছেন বিগত বছরগুলোর মতো এবারও।

শুধু বাড়ির মালিকই নয়, পিছিয়ে নেই ভাড়াটিয়ারাও। বাড়ির মালিক থাকেন না, তাই পেছনের উঠানে ছোটভাইকে সাথে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে শাক-সব্জির আবাদ করেছেন উদ্যোমী যুবক জহিরুল হক। ছুটির দিনে কিংবা বিকালে জব থেকে ফিরে দুইভাই পালাক্রমে পানি দেয়াসহ জমির ও আবাদী সব্জির পরিচর্যা করে থাকেন।  লাল শাক, মুলা শাক, ডাটা শাক, পুই শাক, বরবটি, করলা, শিম, টমেটো, বেগুন, লাউ, কুমড়া, গ্রীন পেপার, নাগা মরিচ, ধনিয়া, শসা, দেশী মরিচ লাগিয়েছেন তিনি। ছোট ছোট বেড তৈরী করে শাক লাগিয়েছিলেন। এখন দ্বীতিয় দফায় শাক লাগানোর প্রস্তুতি চলছে তাঁর।

এদিকে বৈরী আবহাওয়া এবং শাক-সব্জি আবাদে আগ্রহের কারণে গ্রোসারীগুলো চারা, মাটি এবং সারের ব্যবসা করেছে চুটিয়ে। এখানে চারা বিক্রি করছেন কোন কোন গ্রোসারী। 

সিটি লাইন-ওজনপার্কের পুরানো গ্রোসারী শাহজালাল সুপার মার্কেটের পরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান- এবার তাঁরা বিভিন্ন জাতের আড়াই হাজারেরও বেশী চারা বিক্রি করেছেন। ওজনপার্কে বাংলাদেশী কমিউনিটি বড় হচ্ছে তাই চারা, বীজ, মাটিসহ আনুষাঙ্গিক জিনিষের চাহিদাও বাড়ছে। প্রথম দিকে ঠান্ডার কারণে চারা গজাতে চায়নি এবং কিছু চারা নস্ট হয়েছে বলে তিনিও স্বীকার করেন।

মন্তব্য লিখুন :