ঝর্না ধারা চৌধুরী : এক মানবতাবাদীর প্রয়াণ
সমাজসেবা ও জনকল্যাণে আত্মনিবেদিতা, সংসার ত্যাগী, ব্রহ্মচারিণী মানবতাবাদী বরেণ্য ব্যক্তিত্ব শ্রীমতি ঝর্ণাধারা চৌধুরী প্রয়াণে এক অনন্য সমাজকর্মীকে হারিয়েছে দেশ। ৪০ বছরে ধরে নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট এর সচিব’র দায়িত্ব পালনকারী এই মহীয়সী নারী সেই কিশোরী বয়স থেকে বৈষম্য, অনাচার, দূর্যোগ-দূর্বিপাক, অশিক্ষা, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক হানাহানি থেকে যে কোন সংকটকালীন সময়ে ছিলেন উচ্চকন্ঠ। পীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসাবে নিজেক প্রমান করেছেন বারবার। ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে থেকে একজন মানুষ মানবতার প্রতি কতটুকু সংবেদনশীল হতে পারেন তা তিনি দেখিয়েছেন কাজের মধ্য দিয়ে। সাধারণ মানুষ থেকে সহকর্মী সবার প্রিয় ‘দিদি’ হিসাবেই কাজ করেছেন আমৃর্ত্যু।
বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের কালুপুর গ্রামের গান্ধীয়ান প্রথম চৌধুরী ও আশালতা চৌধুরীর ১১ সন্তানের মধ্যে দশম সন্তান ঝর্ণা ধারা চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর। মানবসেবার ব্রত নিয়ে বড় বোনের সাথে সেই কৈশোর বয়সেই সংসার ছাড়েন ঝর্ণা ধারা চৌধুরী।
একুশে ও পদ্মশ্রী পদকপ্রাপ্ত শ্রীমতি ঝর্ণাধারা চৌধুরী ২৭ জুন বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত তাঁর দায়িত্বের প্রতি ছিলেন অবিচল। দীর্ঘ কর্মময় জীবনের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি পেয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অগণিত পুরস্কার ও সম্মাননা। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এবং তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের অনুভূতি প্রমান করে তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর কাজের মধ্যদিয়ে।
শুধু তাইনয় আমাদের চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তিনি মরনত্তোর দেহ দান করেছেন সন্ধ্যানী ডোনার ক্লাবে।
১৯৪৬ সনে ভ্রাতৃঘাতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অব্যাবহিত পরে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে আগমন করেন এবং সহকর্মীদের নিয়ে দাঙ্গা পীড়িত মানুষের মাঝে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেন। সেই সময় গান্ধী কর্মীদের সমাজ সেবামূলক কাজ দেখে শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরী উদ্বুদ্ধ হন এবং এই শিশু বয়সেই নিজেকে সমাজসেবায় উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন অশিক্ষার কারণে সমাজের নারীরা চরমভাবে অবহেলিত ও নিগ্রহের শিকার হয়। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৫৩ সালে নারীদের শিক্ষার জন্যে তাঁর বড় বোন কবিতা দত্ত সহ ‘‘কল্যাণী শিক্ষায়তন’’ নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কিন্তু নারী শিক্ষা বিরোধীতাকারীদের চক্রান্তের কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিকূল পরিস্থতিতে কর্মময় জীবনের অধিকারী ছিলেন ঝর্ণা ধারা চৌধুরী। ১৯৫৪ সালে বাবা মারা যাওায়ার পর ১৯৫৬ সালে যোগ দেন গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত অম্বিকা কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাষ্টে (আজকের গান্ধী আশ্রম ট্রাষ্ট)।
১৯৬০ সালে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সংসারত্যাগীদের সংগঠন চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘে যোগদানের মাধ্যমে সরাসরি মানবসেবা নিয়োজিত হন এই গান্ধী কর্মী। সমাজকর্মের পাশাপাশি তিনি পড়ালেখাও চালিয়ে নেন। তিনি চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। সেখানে শিক্ষিকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি প্রবর্তক সংঘের প্রায় ৫ শতাধিক কিশোরীকে নিরাপদে বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ত্রিপুরার রিলিফ ক্যাম্পে নিয়ে যান এবং সেখানে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৯ সালে পুনরায় ফিরে আসেন গান্ধী আশ্রম ট্রাষ্টে। ১৯৯০ সালের ১৩ জুন মহাত্মা গান্ধীর সহচর চারু চৌধুরীর মৃত্যুর পর ট্রাষ্টের সচিবের দায়িত্ব পান ঝর্ণা ধারা চৌধুরী। সেই থেকেই তিনি আগলে রেখেছেন মানবসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী গান্ধী আশ্রম ট্রাষকে।
এরপরে ১৯৮৯ সালে বর্তমান গান্ধী আশ্রমে যোগদান করে হতদরিদ্র নারীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, কর্মমূখী প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে হাজার হাজার নারীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। শ্রীমতি চৌধুরীর কঠোর পরিশ্রমে মহাত্মা গান্ধীর উদ্বোধন করা বুনিয়াদি শিক্ষা কেন্দ্রটি বর্তমানে “গান্ধী মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট” নামে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এলাকার দরিদ্রতম পরিবারের শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে । স্থানীয়, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ ভাবে মীমাংসায় তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। এই কাজের ধারাবাহিকতায় নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী ও কুমিল্লা জেলার বার লক্ষ হতদরিদ্র পরিবার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে স¤পৃক্ত রয়েছে।
সমাজসেবা, নারী শিক্ষা ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঝর্ণা ধারা চৌধুরী ১৯ ফেব্রুয়ারী “একুশে পদক-২০১৫” লাভ করেন। তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকার ২০১৩ সালে পদ্মশ্রী, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “বেগম রোকেয়া পদক-২০১৩’’, ২০১১ সালে হরিয়ানা কর্তৃক ‘‘রণবীর সিং গান্ধী স্মৃতি শান্তি সদ্ভাবনা’’ পুরষ্কার, চ্যানেল আই এবং স্কয়ার কর্তৃক ২০১০ সালে ‘‘কীর্তিমতি নারী’’ হিসেবে স্বীকৃতি এবং ২০১০ সালে ‘‘শ্রী চৈতন্য’’ পুরষ্কারে ভুষিত করেন।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসন থেকে ২০০৭ সালে ‘‘সাদা মনের মানুষ’’ হিসেবে স্বীকৃতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ থেকে ২০০৬ সালে শান্তির জন্য কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ পুরষ্কার, দূর্বার নেটওয়ার্ক ২০০৩ সালে নারী উন্নয়নের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরষ্কার, ২০০১ সালে পিছিয়ে পড়া নারী জাগরণে অনবদ্য কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘‘অনন্যা পুরষ্কার’’, ২০০০ সালে আমেরিকার ওল্ড ওয়েস্টবেরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘‘শান্তি পুরষ্কার’’, মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ সমাজসেবায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৮ সালে ‘‘আন্তর্জাতিক বাজাজ পুরষ্কার’’ লাভ করেন।
শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরী ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে চিরকুমারী, সংসার ত্যাগী এবং মহাত্মা গান্ধীর ত্যাগের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্থ একজন সদালাপী মানুষ। এই ত্যাগী মহিয়সী নারী মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত ছিলেন অধিকার ও সার্বিক ক্ষমতায়নের বিষয়ে সোচ্চার।
এই মহিয়সী নারীর প্রয়াণে প্রবাসে নোয়াখালী পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আমরাও। তাঁর কর্মের চর্চার মধ্যদিয়ে মানবিক সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসবে তাঁর অগণিত সহকর্মী, সুহৃদ,সহযোদ্ধাÑশুভাকাঙ্খিরা এমন প্রত্যাশা থাকবে আমাদের।
- তথ্যসূত্র : গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট।