খেজুর রস সংগ্রহের প্রস্তিুতে ব্যস্ত গাছিরা

শীতের আগমনী বার্তায় প্রকৃতির পরিবর্তন চারদিকে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা। নোয়াখালীতেও খেজুর রস সংগ্রহে গাছীদের ব্যস্ততা এখন চোখে পড়ার মতো। দিনদিন গাছ কমে আসছে, অথচ;  

কয়েক বছর আগেও গ্রামের প্রায় প্রতিটি এলাকার বাড়ীর দরজায়, ক্ষেতের আইল, সড়কের পাশে ছিল সারি সারি অসংখ্য খেজুর গাছ। শীতের দিনে প্রায় ২-৩মাস খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। নোয়াখালীর হাতিয়া, সুবর্ণচর, কবিরহাট, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকার গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি হিসাবে গাছ কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতনে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ক্রমেই হারিয়ে যাওয়ার পথে।

সরজমিনে জেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ থেকে নোয়াখালীতে শীত কিছুটা বেড়েছে। আর শীতের মৌসুমের আগমনের শুরু থেকেই পেশাদার গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। আর এতে করে পুরো বছর ধরে অযতেœ পড়ে থাকা গ্রামগঞ্জের খেজুর গাছ গুলোর কদরও বেড়ে গেছে। নতুন করে গাছগুলোর অপ্রয়োজনীয় পাতা ছাঁটাই (ঝুড়া) করে রস বের করার উপযোগী করতে ব্যস্ত তাঁরা। গাছে উঠে কোমরে দড়ি বেঁধে পাখির মত ঝুলে ঝুলে এ ছাঁটাইয়ের কাজ কষ্টের হলেও রস সংগ্রহের পর এ কষ্টের অনুভূতি আর থাকেনা বলে জানিয়েছেন গাছিরা। গ্রামঅঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে ‘যত বেশি শীত পড়বে তত বেশি খেজুর গাছ রস দিবে’। তবে গাছ সংকটের কারনে চাহিদা অনুযায়ি রস সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছেনা।  

জানা গেছে, একসময় শীতের মৌসুমে গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে রস দিয়ে রান্না করা হতো রসের ফির্নি, পায়েস, রসের গুড় দিয়ে ভাপা পিঁঠা এবং গাড় রস দিয়ে তৈরী করা হতো মিঠাই, আর সেই মিঠাই দিয়ে শীতের সকালে বানানো হতো চিড়া মুড়ি খঁই। আবার কেউ কেউ চিতল পিঠা বানিয়ে খেজুরের মিঠাই দিয়ে খেতো বেশ মজা করেই। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানা গুড় ও পাটালি গুড় তৈরি করেন অনেকে। যার স্বাদ ও ঘ্রাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে চলতো হরেক রকম পিঠা ফুলির মহা উৎসব। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেতো তখন। এছাড়া খেজুর পাতা দিয়ে আর্কষণীয় ও মজবুত ফাটি তৈরি হয়। জ্বালানি কাজেও ব্যাপক ব্যবহার হয় খেজুর গাছ। এখন অবশ্য নতুন প্রজন্মের কাছে এসব কথা রূপকথার গল্পেরমত মনে হতে পারে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ক্রমান্বয়ে স্মৃতির পাতায় চলে যাচ্ছে খেজুর রস। 

সুবর্ণচর উপজেলার চরক্লাক ও মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের কয়েকজন গাছি জানান, সঠিক পরিচর্যা করলে একটি খেজুর গাছ থেকে ৮-১০বছর পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। উপজেলায় বর্তমানে খেজুর গাছ নেই বললেই চলে। আর যেগুলো রয়েছে তাও একেকটা থেকে একেকটার দূরত্ব বেশি হওয়ায় এখন আগের মত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। গাছ কমে যাওয়ায় এ কাজ ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন, কালের বির্বতনে আজ হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর গাছ।

গাছ ছাঁটাইয়ের ফাঁকে কবিরহাট উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের জগদানন্দ গ্রামের গাছি মো. আব্দুল্যাহ জানান, বাবা-দাদার ঐতিহ্য হিসেবে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহের কাজ  করে আসছেন তিনি। বর্তমানে জগদানন্দ গ্রামের বিভিন্ন জায়গা তার ৪০টি খেজুর গাছ রয়েছে। গাছের ছাঁটাই করে ইতোমধ্যে ৩০টির বেশি গাছ প্রস্তুত করেও নিয়েছেন। রস দেওয়া শুরু হলে উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে বাইসাইকেলযোগে ফেরি করে রস বিক্রি করবেন। গত বছর প্রতিদিন প্রায় ১৫’শ টাকার রস বিক্রি করেছেন। চলতি বছর ভালো রস সংগ্রহ করতে পারবেন বলেও আশাবাদী এই গাছ। তবে অপরিকল্পিত বাড়ী-ঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মানের করার কারণে বর্তমানে খেজুর গাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। 

এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ রক্ষার দাবিও করেন এ গাছিরা।


মন্তব্য লিখুন :