চার জেলার মানুষের পাশে নোয়াখালী পুলিশের অক্সিজেন ব্যাংক

সক্ষমতা বেড়েছে চারগুন

শুধুমাত্র আইনীসেবা নিয়ে নয়, ক্রান্তিকালে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানেও অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে নোয়াখালী পুলিশ। করোনা রোগীদের অতিপ্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহে শুধুমাত্র একটি উদ্যোগের সুফল পাচ্ছেন নোয়াখালীসহ চারজেলার করোনা আক্রান্ত রোগী। শুধুমাত্র মুঠোফোনে একটি কলেই নোয়াখালী পুলিশের ‘কভিড অক্সিজেন ব্যাংক’ থেকে অক্সিজেনের সিলিন্ডার পৌঁছে যাচ্ছে রোগীর বাড়িতে। আর এই মহতি উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন। 

করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের উন্নত চিকিৎসা দিতে ঢাকায় প্রেরণের সময় অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়া থেকে যে উদ্যোগ সূচিত হয়েছে তা পরিণত হয়েছে জনসেবায়। ইতোমধ্যে অক্সিজেন ব্যাংকের সক্ষমতাও বেড়েছে চারগুন। ১০টি হাইফ্লো অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে শুরু হওয়া এ মানবসেবা কার্যক্রমে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে আরও ৪৫টি সিলিন্ডার। এতে অক্সিজেন সেবাগ্রহীতা রোগী এবং রোগীর স্বজনরা যেমন সন্তুষ্ট তেমনি সেবা দিতে পেরেও সন্তুষ্ট অক্সিজেন ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্টরাও। সেবার মান বাড়াতে ব্যাংকে সিলিন্ডারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- গতবছর করোনা সংক্রমনের প্রথম ঢেউয়ে যখন সারাদেশের ন্যায় নোয়াখালীতেও প্রতিদিন হুহু করে বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালে শয্যা সংকটের কারণে আক্রান্তরা নিজ বাসা-বাড়ীতে চিকিৎসা কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাবে চোখের সামনেই মৃত্যুবরণ করছেন আক্রান্ত রোগী। সংকটকালীন সময়ে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এসব দেখেছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। একইসাথে কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও আক্রন্ত হয়েছেন। আক্রান্ত দুইজন পুলিশ সদস্যকে ঢাকায় স্থানান্তরের সময় পথে অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। 

এসব নাড়া দেয় পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেনকে। অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুদেখে নাড়া দেয় ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক এস এম কামরুল হাসানকেও (পিপিএম)। তিনি বিষয়টি উপস্থাপন করলে দ্রুত সাড়া দেন পুলিশ সুপার। ২০২০ সালের ২৮ জুন মাত্র ১০টি হাইফ্লো অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে নোয়াখালী পুলিশ হাসপাতালে যাত্রা শুরু করে ‘কভিড অক্সিজেন ব্যাংক’। বর্তমানে এখানে ৫৫টি হাইফ্লো সিলিন্ডার রয়েছে। 

গত ৫ মে বুধবার পর্যন্ত মানবিক এ ব্যাংক থেকে সেবা নিয়েছেন ২৩৫জন রোগী। যার মধ্যে নোয়াখালীর ১৫৯, লক্ষ্মীপুরের ৬১, ফেনীর ৬ ও কুমিল্লা জেলার ৯জন রোগী রয়েছে। এ কাজে অংশগ্রহণ করেছেন ১৫জন সেচ্ছাসেবী। যারা মোবাইলে কল ফেলে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ছুঁটে যান করোনা রোগীর বাড়ীতে।   

অক্সিজেন সুবিধা পাওয়া কুমিল্লার রাকিব হোসেন জানান, তাঁর মামার প্রচন্ড শ^াসকস্ট দেখা দিলে চিকিৎসক অক্সিজেন সাপোর্টের পরামর্শ দেন। কিন্তু অক্সিজেন প্রাপ্তি নিয়ে কোন তথ্য ছিলোনা, খবর পেয়ে যোগাযোগ করেন নোয়াখালী পুলিশের অক্সিজেন ব্যাংকে। সাড়া পেয়ে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে একটি সিলিন্ডার নিয়ে আসেন। রোগীর অবস্থা উন্নতি হলেও অক্সিজেন সেবা অব্যাহত রাখতে প্রথম সিলিন্ডার জমা দিয়ে আরেকটা সিলিন্ডার আনেন তিনি। বর্তমানে রোগী সুস্থ রয়েছেন।

নোয়াখালী সদরের বাসিন্দা রাসেল চৌধুরী জানান, তাঁর আত্মীয়ের করোনা পজিটিভ হওয়ার পর রাত ২টার সময় পুলিশ অক্সিজেন ব্যাংকের হেল্প লাইনে কল দিলে উনারা রাতেই আসতে বলেন। ওই রাতে এসে কোন প্রকার মূল্য ছাড়া আমরা অক্সিজেন নিয়ে যাই। বর্তমানে তিনি নিজেই অক্সিজেন ব্যাংকে সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন, গর্ববোধ করছেন পুলিশের এ মানবসেবায় নিজেকে যুক্ত করতে পেরে।

অক্সিজেন ব্যাংকের তত্ত্বাবধায়ক ও ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক এস এম কামরুল হাসান জানান, গত বছরের ২৬জুন কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার পথে সুধারাম মডেল থানার সামনে সিএনজি অটোরিকশায় একজন করোনায় আক্রান্ত রোগীকে দেখে এগিয়ে যান। কিন্তু অক্সিজেন না পেয়ে শ^াসকষ্টে কিছুক্ষনের মধ্যেই মারা যান তিনি। চোখের সামনে এমন মৃত্যু যন্ত্রণা দেখে সহ্য করতে না পেরে পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় অক্সিজেন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মাথায় আসে। যথারীতি দুই দিনেই মধ্যেই পুলিশ সুপারের সহযোগিতায় অক্সিজেন ব্যাংকের কাজ শুরু হয়। প্রথম দিকে আমাদের এ সেবা নোয়াখালী জেলায় সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে পাশ^বর্তী লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও কুমিল্লার লোকজনও আমাদের থেকে সেবা নিচ্ছেন।

জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন জানান, করোনার ক্রান্তিকালেও পুলিশ ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে সচেতন করাসহ পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গেছে। এরই মধ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হন। যার মধ্যে দুইজনকে ঢাকা নেওয়ার পথে গাড়ীতে তাদের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। এসব ঘটনা থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে প্রথম অক্সিজেন ব্যাংক চালু করার বিষয়টি চিন্তা করেন।

যেসব রোগীর আত্মীয় স্বজন এসে সিলিন্ডার নিতে পারছেন না, তাদের বাসা-বাড়ীতে সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়াও সিলিন্ডার নেওয়ার পর তা খালি হলে যারা টাকার অভাবে যারা গাড়ী করে তা হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারছেন না তাদের বাসায় আমাদের লোক পাঠিয়ে তা নিয়ে আসা হচ্ছে। খালি সিলিন্ডারগুলো পুনঃরায় রিফিল করার সব খরচ জেলা পুলিশ বহন করছে।

পুলিশ সুপার আরো বলেন- যতদিন করোনার প্রকোপ থাকবে ততদিন বিনামূল্যে এই অক্সিজেন সেবা চালু থাকবে। সেবার মান আরও বাড়াতে অক্সিজেন ব্যাংকে সিলিন্ডারের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।


মন্তব্য লিখুন :