ফুড ডেলিভারিতে এগিয়ে বাংলাদেশিরা



মুজুরী বৈষম্যের বিপরীতে বেশী আয়ের সুযোগ, ব্যাক্তি স্বাধীনতা। চাকরির অনিশ্চয়তা ঘুচাতে বিকল্প পেশা হিসাবেও পছন্দের শীর্ষে ফুড ডেলিভারি। সময়ের সাথে ছুটেচলা নিউইয়র্কের ফুড ডেলিভারিতে নিয়োজিত ই-বাইকারদের নিয়ে লিখেছন রুদ্র মাসুদ

ভাই আমাকে আরেকটা ফুড পিকআপ করতে হবে। তারপর সবগুলো পৌঁছে দিতে হবে। ছবি তুলেই ছেড়ে দিতে হবে, সময় নাই। নিমিষে কথাগুলো বলেই ছুট দিলেন সোহেল (২৬)। ১৯ আগস্ট শুক্রবার নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন ডাউনটাউনের ফুলটন স্ট্রিট ও ব্রডওয়ের মোড়ে বাংলাদেশী পরিচয় জেনে ছবি তুলতে গেলে এমন অভিব্যাক্তি ছিলো এই বাইকারের। ম্যানহাটেনের যেকোন ব্যাস্ততম মোড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সামনে-পেছনে খাবারের সরবরাহকারী কোম্পানীগুলোর রঙবেরঙের ব্যাগ নিয়ে চোখের পলকে সাঁই সাঁই করে ছুটছে ই-বাইকার। যাদের অনেকেই বাংলাদেশী। সোহেলের মতোই ব্যাস্ততা সবার।

নিউইয়র্ক নগর জুড়ে স্বনিযুক্ত, স্বাধীন পেশা এবং ক্রমবিকাশমান কর্মক্ষেত্র হিসাবে বাইকে ফুড ডেলিভারি এখন ব্যাপক জনপ্রিয়। করোনাকালে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেয়া ফুড ডেলিভারি পার্সন/ওয়ার্কারদের সিটি মেয়র এরিক এডামস্ অভিহিত করেছেন ‘লাইফলাইন’ হিসাবে। নগরজুড়ে দিনরাতে ২৪ ঘন্টায় ছুটে চলা প্রায় ৯০ হাজার বাইকারের একচতুর্থাংশেরও বেশী বাংলাদেশী বাইকার। প্রতিযোগীতামূলকভাবে স্বাধীন এ পেশায় এগিয়ে থাকার পাশাপাশি প্রতিদিনই বাড়ছে বাংলাদেশী বাইকারের সংখ্যা। 

মজুরী বৈষম্য, আয় কম হওয়ায় বাংলাদেশী বিশেষ করে তরুন ও যুবকদের মাঝে পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ই-বাইকে ফুড ডেলিভারি। বৈরী আবহাওয়া, ছিনতাই, দূর্ঘটনা এবং হামলার ঝুঁকি নিয়ে ইলেক্ট্রিক বাইক চালিয়ে অ্যাপস্ নির্ভর কোম্পানীগুলোর নিজস্ব আইডি কিংবা শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে কাজ করে থাকেন তাঁরা। কম পরিশ্রমে সন্তোষজনক আয় দিয়ে নিজে চলতে এবং পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন তাঁরা। কেউ কেউ আবার  কাঙ্খিত পূঁজি তৈরী করে পেশা বদল করেছেন। এদিকে  চাকরির অনিশ্চয়তার এই দেশে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসাবেও সমাদৃত হচ্ছে ফুড ডেলিভারি । 

বিকাশমান ও পেশায় টিকে থাকতে পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও দ্রুত সহায়তার বিষয়টি উচ্চারিত হচ্ছে বাইকারদের মাঝে। নিউইয়র্ক নগরে কর্মরত ডেলিভারি ওয়ার্কারদের নিয়ে কাজ করা বৃহৎ সংগঠন ‘লস ডেলিভারিস্টাস ইউনিডোস-এলডিইউ’ অধিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে বাইকারদের ঐক্যবদ্ধ করে নগর কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিয়ে আইন করিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের সাথে যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশী বাইকারদের সুরক্ষায় কাজ করছে দেশীজ রাইজিং আপ এন্ড মুভিং- ড্রাম। 

বাইকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়- বৈধ কাগজপত্র না থাকলে ন্যায্য মজুরী পাওয়া যায় না। এরসাথে অভিজ্ঞতার বিষয়টি জুড়ে দিয়ে কম বেতন দেওয়া হয় নতুন অনভিজ্ঞ অভিবাসীদের। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা একজন ব্যাক্তি সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড এবং ওয়ার্ক পারমিট পেতে প্রায় একবছর লেগে যায়। অনেকের আরো বেশী সময় লাগে। এই সময়টাতে যে কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গেলে ৬০ থেকে ৬৬ ঘন্টা কাজ করিয়ে যে বেতন দেওয়া হয় তা দিয়ে চলা দুস্কর হয়ে পড়ে। অথচ; বাইকে ডেলিভারি দিলে ৪০ থেকে ৫০ ঘন্টা কাজ করলে ১২’শ থেকে ১৪’শ ডলার সহজেই আয় করা সম্ভব। তাছাড়া নিজের ইচ্ছামতো কাজে যাওয়া আসা করা যায় এবং কোন জবাবদিহি করতে হয়না কাউকে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- একটা সময় নতুন অনভিজ্ঞরা কনস্ট্রাকশন, রেস্টুরেন্ট, পিজা-ফ্রাইড চিকেন, নাইন্টিনাইন সেন্ট, গ্রোসারি, ক্যান্ডি স্টোর, গিফট্ শপসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ দিয়ে অভিবাসী কর্মজীবনের সূচনা করতো। রেস্টুরেন্ট,ডমিনোজ, পাপা জোন্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিও ছিলো। তখনও অনলাইনে খাবারের অর্ডার চালু ছিলো। অ্যাপস্ এর মাধ্যমে ফুড ডেলিভারি জনপ্রিয়তা পায় ২০১৬ সালের দিকে। ই-বাইকের পাশাপাশি  বাংলাদেশীরা নিজস্ব গাড়িতে করে ডেলিভারি শুরু করেন। 

ক্রমেই এই ধারা বদলে যাচ্ছে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসাদের মাঝে বেশীরভাগই ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ফুড ডেলিভারির প্রভাবে এখন কনস্ট্রাকশন, রেস্টুরেন্ট, পিজা-ফ্রাইড চিকেন, নাইন্টিনাইন সেন্ট, গ্রোসারি, ক্যান্ডি স্টোর, গিফট্ শপের মতো কাজে তরুন-যুবদের অনীহা প্রচন্ড। ফলে এসব ক্ষেত্রে লোকবল সংকটও দেখা দিয়েছে। বেতন বাড়িয়েও অনেকে কাজের জন্য লোক পান না অনেকে। আগে একজন কাগজপত্রহীন কিংবা অনভিজ্ঞ বাংলাদেশী যেখানে ৬০ থেকে ৬৬ ঘন্টা কাজ করে সাপ্তাহে ৪’শ থেকে ৬’শ টাকা আয় করতেন। সেখানে এখন ৬’শ থেকে ৮’শ টাকা আয়ের সুযোগ থাকে। কনস্ট্রাকশনসহ ক্ষেত্র বিশেষে আয় আরো কিছু বেড়েছে। বিপরীত দিকে ৪০ থেকে ৫০ ঘন্টা ডেলিভারি দিয়ে কম পরিশ্রমে প্রায় দ্বিগুন আয় করা সম্ভব হয়। কাজ করার জন্য নিজের বৈধ কাগজপত্র হাতে পেতে সময় লাগলে আইডি শেয়ারিয়ের মাধ্যমে অনেকেই দ্রুত ডেলিভারিতে নেমে পড়েন।

তবে; বৈরী আবহওয়া, শীতকালে তুষারপাত কিংব শৈত্য প্রবাহের মতো বিরুদ্ধ পরিবেশ মোকাবেলার কস্টের কথাও বলেছেন অনেকে। পাশাপাশি দূর্ঘটনা, ছিনতাই, হামলা, বাইক চুরি ও ব্যাটারি চুরির মতো ঘটনাতো রয়েছেই। ইতোমধ্যে গত দেড় বছরে ৪ বাইকারের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

প্রবাসে নোয়াখালীর সাথে আলাপকালে তরুন বাইকার মাহমুদুল হাসান বলেন- ২০১৮ সালে আসার পর বৈধ কাগজপত্র না থাকায় প্রথমে নাইন্টিনাইন সেন্ট পিজা দোকানে কাজ করেছিলেন। অমানুষিক পরিশ্রমের পরেও সাপ্তান্তে ৪৫০ থেকে ৫০০ ডলার মিলতো। এখন কোন চাপ নেই, যখন ইচ্ছা কাজে যান। সাপ্তাহে ৪০ থেকে ৫০ ঘন্টা কাজ করলেই হয়। যা আয় হয় তাতেই সন্তোষ প্রকাশ করেন এই তরুন। তবে; এ পেশারও সিজন রয়েছে। বৈরী আবহওয়ায় বেশী অর্ডার মিলে। কিন্তু; কস্টেরও সীমা থাকেনা বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বাইকারদের কথা ধ্বনিত হয়েছে ব্রুকলিন ডাউনটাউনের তরুন রেস্টুরেন্ট ব্যাবসায়ী মহিন উদ্দিনের কন্ঠেও। তাঁরমতে শুধু বেতন কম কেন? একসময় কাজ পাওয়াও কস্টের ছিলো। এখন তাঁর রেস্টুরেন্টে যারা ডেলিভারি দেয় তারাও আগের চেয়ে দ্বিগুন আয় করে। আর যারা ভেতরে কাজ করে তাদেরও বেতন বেড়েছে। কিন্তু এখন অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ লোক পাওয়াও দুস্কর। বাইকে ডেলিভারির প্রভাবে এমনটি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন- অনেকে কাজও শিখতে চায়না। ফলে রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন সাইডে দক্ষ জনবল তৈরী হচ্ছেনা। এক্ষেত্রে আবার বাংলাদেশীরা পিছিয়ে পড়ছে।

এদিকে নিউইয়র্ক সিটির কনজিউমার এন্ড ওয়ার্কার প্রোটেকশন বিভাগ বাইকে ফুড ডেলিভারিকে “অনলাইন থার্ড পার্টি ফুড ডেলিভারি সার্ভিস ইন্ডাষ্ট্রি” হিসাবে অভিহিত করে থাকে। এ বিভাগ ভোক্তা ও বাইকারদের সুরক্ষায় তিনধাপে বাস্তবায়নাধীন নুতন আইনের ঘোষণা করেন মেয়র এরিক এডামস। এনিয়ে গত ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় নগরে অ্যাপস্ এর মাধ্যমে ৬৫ হাজরের বেশী বাইকার ও ২০ হাজারের বেশী রেস্টুরেন্টে অ্যাপের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করে থাকে। 

এদিকে উল্লেখিত বাইকারদের পাশাপাশি রেস্টুরেন্টগুলোর নিজস্ব ভেলিভারি ওয়ার্কার এবং আইডি শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে কাজ করা বাইকারসহ বর্তমানে সবমিলিয়ে ৯০ হাজার বাইকার নিউইয়র্কে খাবার সরবরাহে সক্রিয় বলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও সংবাদমাধ্যমগুলোর হিসাব। বাইকারারা গ্রাবহাব, উবার ইট, পোস্টমেটস্, ডোরডেশ, ক্যাবিয়ার, ডেলিভারি ডট কম, চোওনাউ প্রভৃতি অনলাইন অ্যাপ’র মাধ্যমে কাজ করে থাকেন।

বাইকারদের এই সংখ্যার প্রতি সহমত পোষণ করে বাংলাদেশী বাইকারদের সংখ্যা এক চতুর্থাংশ বলে মন্তব্য করেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দেশীজ রাইজিং আপ এন্ড মুভিং- ড্রাম এর পরিচালক কাজী ফৌজিয়া। তাঁরমতে প্রতিনিয়ত এই পেশায় যুক্ত হচ্ছে নতুনরা।

বিকল্প আয়ের সুযোগ-

শুধু নতুনদের কাছে পছন্দের পেশা নয়। বিভিন্ন পেশায় কর্মরত এমনকি ভালো চাকরি করেন এমন কেউ কেউও বাড়তি আয়ের জন্য খন্ডকালীন ফুড ডেলিভারি করে থাকেন। পাশাপাশি চাকরি অনিশ্চয়তার এই শহরে চাকরি হারালে অনায়াসে যে কেউ বাইক অথবা কার নিয়ে নেমে যাতে পারেন এপেশায়। 

এমন কথা ধ্বনিত হয়েছে নিজের কারে খাবার ডেলিভারি করা মাসুদ রানার কন্ঠে। তিনি আগে একটা দোকানে চাকরি করতেন এখন গাড়িতে করে খাবার ডেলিভারি দিয়ে থাকেন। 


মন্তব্য লিখুন :