মওদুদ আহমদ আর নেই

সকল সরকারের সময়েই জেলে খেটেছিলেন

প্রবীন রাজনীতিবিদ সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি নোয়াখালীর কৃতি সন্তান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর নেই। বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাযেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকালেন করেন (ইন্নলিল্লাহে.....রাজেউন)। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। নোয়াখালীতে দলমত নির্বিশেষে সবাই শোক প্রকাশ করেন। নিজ জেলা নোয়াখালীতে অভাবনীয় উন্নয়নের সাথে জড়িয়ে আছে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নাম। তাঁর মরদেহ নিজ এলাকা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের সিরাজপুর ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মা’র কবরের পাশে দাফন করা হবে। 

প্রবীন এই আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। শোক জানিয়েছেন জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ব্যারিস্টার মওদুদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত চরিত্র। দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৬ সালে বিএনপিতে ফেরার পর আমৃত্যু দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী মওদুদ আহমদ।  

মৃত্যুর সময় তার সহধর্মিণী হাসনা মওদুদ হাসপাতালে ছিলেন । তাদের মেয়ে নরওয়েতে আছেন। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে মওদুদ আহমদের মরদেহ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় দেশে আনা হবে। শুক্রবার সকাল ৯টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম জানাজা, সকাল ১০টায় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় এবং সকাল ১১টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তৃতীয় জানাজা শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে নিজ এলাকা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। সেখানে বাদ আসর শেষ জানাজা হবে। পরে পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একান্ত সহকারি মোমিনুর রহমান। 

মওদুদ আহমদ কিডনি, ফুসফুসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ২৯ ডিসেম্বর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে দেশে চিকিৎসা নেন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে ২০ জানুয়ারি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। পরদিনই ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ১ ফেব্রুয়ারি নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। ক'দিন ধরেই আইসিইউতে ছিলেন মওদুদ আহমদ। তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। ফুসফুসে পানি জমে অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়। কিডনিও ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছিল।

১৯৪০ সালে ২৪ মে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক আলোচিত চরিত্র। ছয়বারের এমপি মৃদুভাষী মওদুদ আহমদ দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে খ্যাত ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে বার এট ল' ডিগ্রি নেওয়া মওদুদ আহমদ আইনজ্ঞ হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য আসামিদের আইনজীবী দলের সদস্য ছিলেন। একাত্তরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন। বহির্বিশ্বে পাকিস্তানি গণহত্যা তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার মওদুদ আহমদকে পোস্টমাস্টার জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়।

১৯৭৪ সালে ৩৩ নাগরিক মিলে 'কমিটি ফর সিভিল লিবারটিস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড' গঠন করেন মওদুদ আহমদ। এ কমিটি সে সময় কারান্তরিত বিরোধী রাজনীতিকদের আইনি সহায়তা দিত। ওই বছরের ডিসেম্বরে কারাগারে যান মওদুদ আহমদ। তবে দ্রুতই ছাড়া পান। পরে মওদুদ আহমদ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকারে যোগ দেন। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৯ সালে জন্মস্থান নোয়াখালীতে প্রথমবার এমপি হন। জিয়াউর রহমানের সরকারে মন্ত্রী ও পরে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

এরশাদের সামরিক শাসনের কড়া সমালোচকদের একজন ছিলেন মওদুদ। দুর্নীতির মামলায় সামরিক আদালত তাকে ১০ বছর কারাদ দেন। কিন্তু ১৯৮৫ সালে এরশাদের সরকারে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। পরে প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতিও হন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে তিন জোটের রূপরেখায় উপরাষ্ট্রপতি পদ ছাড়েন। মওদুদ আহমদ '৯১ সালে জাতীয় পার্টি থেকেই এমপি হন ওবায়দুল কাদেরকে হারিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সেই সময়কার বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রণীদের একজন ছিলেন। '৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে হেরে যান। জাতীয় পার্টি ছেড়ে ফিরে আসেন বিএনপিতে। ২০০১ সালে এমপি ও খালেদা জিয়া সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া বগুড়া-৭ আসন থেকে উপনির্বাচনে জিতে এমপি হন।

মওদুদ আহমদ পাকিস্তান আমল, বঙ্গবন্ধু সরকার, এরশাদ সরকার, ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট সরকারের সময়ে জেল খেটেছেন। কারাগারে বসে তিনি ডজনের বেশি বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- 'ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট :এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ', 'বাংলাদেশ :এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ কনস্টিটিউশনাল কোয়েস্ট ফর অটোনমি', 'বাংলাদেশ :ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ' ইত্যাদি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও নেপথ্য ঘটনাপরম্পরা বিশ্নেষণে বইগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলে গণ্য করা হয়। মওদুদ আহমদ ছিলেন শিক্ষকও। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউস, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, ফেয়ারব্যাংক এশিয়া সেন্টার এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান ইনস্টিটিউটের ফেলো ছিলেন। ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং প্রফেসর।


তথ্যসূত্র- দৈনিক সমকাল।


মন্তব্য লিখুন :